পর্ব-১
আষাঢ় মাসের দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। এ সময় সাধারণত আকাশ মেঘলা থাকারই কথা। কিন্তু এখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে রায়হান সাহেব বগলের তলে রাখা ছাতাটা মেলে ধরলেন মাথার উপর। আরেক হাতে তার বাজারের ব্যাগ। পায়জামাটা হাঁটুর কাছে ভাঁজ করে তুলেই তিনি ছপ ছপ পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন মেইন ফটকের দিকে।
মনে মনে ভাবছেন, আজ কি বাজার করা যায় ! প্রায় ৮ বছর পর আজ তার বড় মেয়ে বীথি এসেছে বিদেশ থেকে। সাথে জামাই ও দুই ছেলে মেয়ে ছোটন এবং সুরেলা । বৃষ্টির দিনে বীথি ভুনা খিচুরী আর গরুর মাংস খুব পছন্দ করতো। তাহলে সেটাই নেয়া যাক।
কিন্তু যদি মেয়ের শখ এতদিনে বদলে গিয়ে থাকে! কে যানে! হয়তো এখন ভুনা খিচুরী আর গরুর মাংসের বদলে বৃষ্টির দিনে তার মেয়ে সী-ওইড কিংবা আফ্রিকান লাং ফিশ খেতেই বেশী পছন্দ করে।
রায়হান সাহেব এর কপালে আরেকটা বিরক্তির ছাপ পরলো। নিজ মনে বিড়বিড় করতে করতেই তিনি বাজারের দিকে ছুটলেন।
রায়হান মুস্তফা। একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা। তিন মেয়ে বীথি, প্রীতি ও রানু। কোন ছেলে সন্তান নেই উনার। স্ত্রী রাহেলা খাতুন। কিছুটা ওজনদার হলেও অত্যন্ত দায়ীত্বশীল ও মায়াবী মনের একজন স্ত্রী রাহেলা। তিন মেয়েকে বলতে গেলে রাহেলা খাতুনই আদর যত্ন ও শাসনে রেখে মানুষ করেছেন। যদিও তিন মেয়েই আড়ালে আড়ালে বাবার বেশী ভক্ত।
রায়হান সাহেবের তিন মেয়েই অসম্ভব রুপবতী ।এইচ এস সি পাশ করার পরই বীথির বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী মন্জুরুল হক, বড় সাদাসিধা ঘরকুণো টাইপ ভদ্রলোক ।
প্রীতি, রায়হান সাহেব ডাকেন প্রীতিলতা বলে বাকহীন বধীর বলে স্কুলের চৌকাঠ মাড়ানো হয়নি। অথচ এই মেয়েটিই রায়হান সাহেবের সব চেয়ে রুপবতী ও গুনবতী মেয়ে।
সবার ছোট রানু। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকসে অনার্স করছে ফাইনাল ইয়ার।
চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার পর পেনশন এর টাকা ও বাড়ী ভাড়া দিয়েই রায়হান সাহেবের সংসার চলে যায়। একতলা ও দুইতলা ভাড়া দেয়া। নিজেরা থাকেন তিন তলায়।আর সময়ে অসময়ে এমেরিকা প্রবাসী মেয়ে বীথি তো আছেই।
*
আজ ভুনা খিচুরী আর গরুর মাংস রান্না করেছেন রাহেলা খাতুন। কতদিন পর তিন মেয়েকে এক সাথে নিজ হাতে বেরে খাওয়াচ্ছেন । মঞ্জুরুলকে একটু বেশীই সমাদর করে খাওয়ানো হচ্ছে। জামাই বলে কথা! বীথি গরগর করে অনর্গল তার এমেরিকার গল্প করেই যাচ্ছে। রাহেলা খাতুন এর এই মেয়েটি একটু বোকা টাইপের। অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে গুলো বোকাই হয় ।
ছোটন আর সুরেলা বসেছে রানুর দু’পাশে ।পরম আদরে রানু ওদের মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে।
রাহেলা খাতুন হঠাৎ লক্ষ্য করলেন প্রীতি কেবল তার প্লেটের খাবার নেড়ে চেড়েই যাচ্ছে। মুখে দিচ্ছেনা।
–কি রে মা, খাচ্ছিস না যে ! ভাল হয়নি বুঝি ? বলেই রাহেলা খাতুন এগিয়ে গেলেন প্রীতির দিকে।
প্রীতি মাথা ঝাকিয়ে জানালো যে খাবার ভাল হয়েছে। তারপর এক হাতে মা এর কোমর জড়িয়ে ধরেই আস্তে আস্তে খেতে লাগলো। যেন মা কে ছুঁয়ে খুব অসস্থিকর কিছু একটা থেকে মুক্তি পেলো প্রীতি ।
ঝুম বৃষ্টির সাথে যোগ হয়েছে আজ বিজলী চমকানো। ছোটন আর সুরেলা তো ভয়ে অস্থির। বীথি বাচ্ছাদের পাঠিয়ে দিলো বাবার ঘরে। আজ শুধু তিন বোন গলা জড়িয়ে গল্প করবে।
*
এক খাটে তিন বোন। বীথির কোলে মাথা রেখে প্রীতি শুয়েছে। রানু তার গাল আলতো ছুঁয়ে প্রীতির পা জড়িয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে বীথির কথা শুনছে । বীথি খুব মমতায় প্রীতির চুল গুলো টেনে দিচ্ছে।
এমন সময় রাহেলা খাতুন এসে দরজায় টোকা দিলেন।
–ভিতরে এসো মা, বলল বীথি।
রাহেলা খাতুন ঘরে ঢুকলেন । মেয়েদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– চা খাবি নাকি রে মা? খাঁটি গাইয়ের দুধের চা।
প্রীতি মাথা ঝাকিয়ে জানালো সে খাবে। বীথি বলল, নিয়ে এসো মা। ৪ কাপ চা। তুমিও আমাদের সাথে খাবে আর গল্প করবে।
রাহেলা খাতুন চলে গেলেন চা বানাতে। রানু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
–আচ্ছা আপু, দুলাভাই রাগ করবেনা তুমি যে উনাকে একা ফেলে আমাদের সাথে গল্প করছো?
বীথি কিছুটা বিরক্তি সুরেই বলল, করুক। ৮ বছর গায়ে গায়ে লেগে ছিলাম। উফফ!!!
রানুর চোখে মুখে দুস্টুমী খেলে গেলো। আরেকটু কাছে বীথির গা ঘেঁসে জিজ্ঞেস করল,
– দুলাভাই কি খুব বউখেকো নাকি আপু ?
বীথির চোখ গোল হয়ে গেলো। ছোট থেকেই কোন এক বিশেষ কারণে অবাক হওয়ার মত কিছু ঘটলেই বীথির চোখ গোল হয়ে যায়।
– বউখেকো কি? গোল গোল চোখে বীথির প্রশ্ন।
– বউখেকো হচ্ছে যারা বউ বউ করে দিন রাত বউ এর আঁচল ধরে রাখে। অতি ভালবাসা বিলাতে গিয়ে বউ কে জেল খানার কয়েদী বানিয়ে দেয়। একটা নির্দিস্ট বৃত্তের বাহিরে সেই বউ পা বাড়াতে পারেনা। সেই বউ এর কাজ হচ্ছে, দিন রাত শুধু স্বামীর গদ্গদ ভালবাসা দেখে লজ্জায় লাল, নীল, হলদে রঙ ধরা। ভ্যানেটি ব্যাগের মত সেই স্বামীকে ডান হাতে ঝুলিয়ে হেলে দুলে হাঁটা।
প্রীতি খিক করে হেসে উঠলো। বীথির চোখ আরো গোল হয়ে গেলো। বলে কি এই মেয়ে। অবাক বিস্ময়কর গোলাকার চোখে বীথি বলল,
– তুই তো খুব বেশী পেকে গেছিস রে রানু!
– হি হি হি । এটাকে পাকা বলেনা আপু। এটা হচ্ছে পেকে পেকে ঝাঞ্জুরা হয়ে যাওয়া । অনেকটা সবুজ থেকে বাদামী বর্ণ ধারণ করা নারিকেল এর মত। বলেই আবার হাসতে লাগলো রানু।
মেয়েদের খুনশুটিতে রাহেলা বেগম চা এর ট্রে হাতে এসে ঘরে ঢুকলেন।
পর্ব-২
আজ দিনটা বেশ ফুরফুরা। কিছুটা রোদের ঝলকানি,সেই সাথে শীতল বাতাস। এ সময় দক্ষিনের বারান্দাটা প্রীতির খুব প্রিয়। এমন সময় প্রায়ই সে বারান্দায় বসে টুকটাক সেলাই করে। সেলাই করা প্রীতির অভ্যাস। আজও সে সুঁই সুতোয় এফোড় ওফোড় করে রংচটা নকশী কাঁথা করছে। বীথিকে দেবে বলেই গত এক মাস ধরে কাঁথা নিয়ে বসেছে মেয়েটা।
তিন মেয়ের মাঝে প্রীতিলতার প্রতি রায়হান সাহেবের মমতা যেন একটু বেশীই। হয়তো বধীর বলেই। অসহায় পিতার অনুশোচনাবোধ প্রীতিও বুঝতে পারে।
মেয়েকে অনেকক্ষন যাবত বারান্দায় দেখছেন তিনি। এমন মায়াবতী মেয়েটা কোনদিন তাকে বাবা বলে ডাকবেনা- ভাবতেই চোখ ভিজে উঠলো রায়হান সাহেবের। আজ নতুন নয়, প্রায়ই এই ভাবনাটা তাকে কষ্ট দেয়। বাস্তবতায় হামাগুড়ি দিতে দিতে তিনি ভাবলেন, মেয়েটাকে চা-টুকু দিয়ে আসি।
চায়ের কাপ হাতে রায়হান সাহেব এগিয়ে গেলেন মেয়ের দিকে। বললেন,
– কিরে মা! চা খাবি? বলেই মেয়ের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলালেন।
ঘার নেড়ে প্রীতি জানালো খাবে। রায়হান সাহেব মেয়ের হাতে চা এর কাপ তুলে দিয়ে পাশে বসলেন । প্রীতি চা এ চুমুক দিয়ে বাবার দিকে তাকালো একবার। হয়তো এতক্ষনে প্রীতি বুঝতে পেরেছে যে বাবা না খেয়ে তার ভাগের চা দিয়ে দিয়েছেন মেয়েকে।
প্রীতি দু’চুমুক দিয়েই চা এর কাপটা বাবার দিকে এগিয়ে দিলো। ইশারায় বুঝালো বাকিটা বাবার জন্য।
রায়হান সাহেবের চোখ ভিজে এলো আবারো। ভাবলেন, মেয়েটা এত মায়াবতী হয়েছে কেন! এত ভালো একটা মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনতে কার না ইচ্ছে করে! রায়হান সাহেব অশ্রুভেজা চোখে মেয়ের পাশ থেকে সরে এলেন।
বারান্দার কোনায় রাখা তার ইজি চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে রায়হান সাহেব ভাবতে লাগলেন- মেয়েটার বয়স প্রায় ২৬ ছুঁই ছুঁই। ছোট মেয়ে রানুর জন্য বিয়ের সমন্ধ আসছে। কিন্তু প্রীতিকে রেখে রানুকে বিয়ে দেয় কি করে! এই মেয়েটাকে একটা বিয়ে দিতে পারলে যেন শান্তিতে মরতে পারতেন তিনি। কিন্তু প্রীতিকে বিয়ে করবে কে! মেয়ে যে বাকহীন বধীর!
এমন ভালো একটা মেয়ে তার। তার বিয়ে হবেনা! কেউ তাকে ভালবেসে খোঁপায় ফুল গুঁজে দিবেনা! যদি তিনি না থাকেন তাহলে মেয়েটার কি হবে? এসব নানান ভাবনায় রায়হান সাহেবের বুক ভার হয়ে এল।
*
সুরেলা আর ছোটন রানুর সাথে বিছানায় শুয়ে কার্টুন দেখছে। এমন সময় রাহেলা খাতুন শাড়ীর আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে ঘরে ঢুকলেন ।
– কি দেখছিস রে তোরা? খাটে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন।
– কার্টুন মা, রানু বলল।
– বাংলা চ্যানেলটা ধর না রে মা, কি সব কার্টুন দেখিস সারাদিন!
মা’কে অস্বীকার করার উপায় নেই রানুর। সারাদিনের কর্মব্যাস্ততার পর ঘন্টা খানেক বাংলা টিভি না দেখলে রাহেলা খাতুনের ঘুম হয়না। চ্যানেল বদলে দিল রানু।
সুরেলা আর ছোটনের মুখ বাকা হয়ে গেল। দুই ভাই বোন একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। রানু কিছুটা মজা করার উদ্দ্যেশে জিজ্ঞেস করলো,
– হোয়াট ইজ দ্যা ঘটনা ভাগ্না/ভাগ্নি?
সুরেলা কপাল কুঁচকে বলল,
– ইউ ডিড নট ইভেন এ্যাস্ক আস বিফোর ইউ চেঞ্জ দ্যা চ্যানেল!
– সরি জান্টুমনি! মাই মিস্টেইক। এইবারের মত এক্সকিজ মি প্লিজ….বলেই রানু সুরেলা আর ছোটনকে কাতুকুতু দিতে লাগলো। ওরা খিল খিল করে হেসে উঠলো।
রানু মনে মনে বলল, পৃথিবীর সকল শিশুগুলির হাসি এত কিউট হয় কেন?
ওদিকে রাহেলা খাতুন এর মুখ হা হয়ে আছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আক্রমনের জন্য ব্ল্যাক ম্যামবা তার বিশালাকৃতির মুখ হা করে রেখেছে। রানু জানে তার মা’য়ের এই বিশ্ময়কর চেহারার মানে।
রানুর দিকে অবাক চোখে তাকালেন রাহেলা খাতুন। বললেন,
– একি! বড়রা চ্যানেল বদলাবে। তাতে সরি বলার কি আছে?
রানু বলল,
– মা, এটাই এমেরিকানদের নিয়ম। তুমিও সরি বলো।
– এ….কি বলছিস তুই? আমি এই পিচ্ছিদের কেন সরি বলবো? কি করেছি আমি?
রানু বুঝতে পারছে ব্ল্যাক ম্যামবা এখন ফুঁসে উঠেছে।যে কোন মুহূর্তে ছোবল বসাবে। রানু বলল,
– তুমি বিরাট এক অন্যায় করেছো মা। টিভির চ্যানেল বদলানোর আগে ওদের পার্মিশন নাওনি। এখন ওদের বলো- সরি ছোটন সোনা। সরি সুরেলা ময়না।
ব্ল্যাক ম্যামবা হঠাৎ নেতিয়ে পরেছে। রাহেলা খাতুন বললেন,
– সরি ছোটন সোনা। সরি সুরেলা ময়না।
– ইটস ওকে গ্র্যান্ডমা। ছোটন ও সুরেলা দু’জনেই বলল।
রাহেলা খাতুন সামান্য হাসি দিলেন। এই হাসি সেই হাসি নয়। এই হাসির মানে ‘যদি তোরা বাংলাদেশে পয়দা হইতি তো বুঝাইতাম কত ধানে কত চাল।”
এমেরিকানদের সাথে বাঙ্গালী পরিবারের সদস্যদের প্রায়ই কিছু প্রথা ও ভদ্রতার সংঘর্ষ ঘটে। যেমন রাহেলা খাতুন ভাবছেন, বড়রা যখন খুশী তখন যে কোন সিদ্ধান্ত নিবেন। তাতে ছোটদের পার্মিশন লাগবে কেন? এ ব্যাপারে এমেরিকাযন সংস্কৃতিতে ভিন্ন ব্যাবস্থা। সেখানে যে কোন বিষয়ে ছোটদের ও প্রাধান্য দেওয়া হয়। ওরা বিশ্বাস করেন যে, ছোটদের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হলে তাদের আত্ববিশ্বাস ও মনোবলকে জোড়দার করা হয়। ছোট থেকেই প্রতিটি শিশুর আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বৃদ্ধি না করলে, বড় হয়ে সে অকর্ম্য হয়। জীবনে সাফল্য আনতে পারেনা।
যাই হোক, ততক্ষনে রাহেলা খাতুন বাংলা ছবি দেখা শুরু করেছেন। ছবির নাম স্বামী কেন আসামী। কলকাতার ঋতুপর্না সেন দারুন উদ্দীপনায় গানের সাথে নেঁচে যাচ্ছেন। তেলাপোঁকার মত চার দিকে হাত পা ছুড়াছুড়ি করছে। রাহেলা খাতুন গভীর মনোযোগ প্রদর্শন করে দেখছেন। নাচ ভঙ্গির সাথে সাথে উনার চেহারার অবস্থানও বদলাচ্ছে।
– হোয়াই দে আর থ্রোয়িং দেয়ার আর্মস এন্ড ল্যাগস টু ইচ আদার? দাদীমাকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে আবার টিভির দিকে তাকাল সুরেলা। রাহেলা খাতুন কিছুই বুঝতে না পেরে রানুর দিকে তাকালেন। বললেন,
–এই রানু। বাংলায় তর্জমা কর।
মা’কে ছুড়ে দিয়ে রানু সুরেলাকে বলল,
– ওদের শরীরে এলার্জী হয়েছে। গা চুলকাচ্ছে । তাই এমন অস্থির ভাবে হাত পা ছুড়ছে সোনা। নো টেনশন।
– হি হি হি। দ্যা আর সো ফানি এ্যান্ট।
সুরেলা যেন খুব মজা পেলো।
এবার রাহেলা খাতুন নাত্নির প্রশ্ন সম্পর্কে অবগত হলেন। বিরক্তি নিয়ে ভাবলেন,এমন পাক্না ঝুলঝুলা মেয়ে তার মেযের ঘরে জন্মালো কি করে!
*
মঞ্জুরুল হক খাটে হেলান দিয়ে গভীর মনোযোগে ম্যাগাজিন পরছেন। বীথি ড্রেইসিং টেবিল এ তার চুল ঠিক করায় ব্যাস্ত। আড়চোখে স্বামীকে একবার দেখে নিলো বীথি।
– এই শোনো। ডাকলো বীথি।
– হুম। ম্যাগাজিন থেকে চোখ না তুলেই উত্তর দিলেন তিনি।
– বাবা বলছিলেন গ্রামে আমাদের বাগান বাড়ীতে নিয়ে যাবে। সকালে যাবো। রাতের মদ্ধেই ফিরবো। কি বলো?
–অজপারা গায়ে আমার যেতে ভালো লাগেনা। তোমরা যাও না প্লিজ, আমি বাসায় থাকি।
– বাবা কি মনে করবেন তুমি না গেলে?
– বাবাকে বুঝিয়ে বলো প্লিজ। বলেই মঞ্জুরুল হক উঠে গিয়ে বীথির কোমর জড়িয়ে ধরলেন।
– আহ! হচ্ছে কি এসব ! ছাড়ো। কেউ এসে পরবে।
বলেই বীথি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। এমন সময় রানু এসে দরজায় টোকা দিল। বললো,
– আসবো ভিতরে আপু?
– আয়। বলেই কাপরটা ঠিক করে নিলো বীথি।
রানু ট্রে তে করে দুটো পায়েস এর বাটি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। বীথিকে এক বাটি হাতে দিয়ে আরেক বাটি দুলাভাইয়ের হাতে দিয়ে বিছানায় বসলো।
– কি শালীকা, কাল নাকি বাগান বাড়ী যাচ্ছো? ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে মঞ্জুরুল হক জিজ্ঞেস করলেন।
– হুম যাচ্ছি। আপনি যাবেন না?
– নাহ। আমার কিছু প্রজেক্টের কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ করে ওদের সাবমিট করতে হবে মেইল এ। তোমরা এঞ্জয় করো।
– ওহ। বলেই রানু উঠে দাড়ালো। বীথি পায়েস খাচ্ছিলো। রানুকে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– কি রে! প্রীতির কি মাথা ব্যাথা কমেছে?
– নাহ । বললো রানু ।
– তাহলে?
– তাহলে কি? রানুর দৃষ্টিতে প্রশ্ন।
– তাহলে কাল কি বাগান বাড়ী যাওয়া হবেনা?
– ওর শরীর ভালো না হলে কি করে যাই? বললো রানু ।
– এক কাজ করা যায়। রাতারাতি প্রীতি সেরে উঠলে তো ভালই। আর না হলে, চিন্তার কিছু নাই। তোর দুলাভাই যাচ্ছেনা। প্রীতিকে দেখে রাখতে পারবে। আমরা তো রাতের আগে চলেই আসছি। বৃষ্টি বাদলার দিন। কখন আবার আবহাওয়া খারাপ করে। বাচ্ছাদ্র নিয়ে টেনশনে থাকি।
কথাগুলো বলে বীথি দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছারলো। যেন বিশাল এক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে।
– দেখা যাক। হয়তো সকালের মধ্যে সেরে উঠবে।
বলেই রানু ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। যেতে যেতে ভাবলো, আসলেই সুন্দরী মেয়ে গুলো বোকা হয়। শুধু বোকা না, ওরা যে গৃহপালিত প্রাণির মত অনুগত, সেটা বীথিকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেনা।
*
সবাই খুব সেজেগুঁজে আছে বাগান বাড়ী যাবে বলে। বীথি পরেছে লালের উপর সবুজ পাড়ের শাড়ী। সুরেলা, ছোটন কে সকাল সকাল গোসল দেওয়া হয়েছে। মঞ্জুরুল হক তখনো আধাশোয়া হয়ে বিছানায় খবর দেখছেন টিভিতে। এই নিয়ে তিনবার বীথি শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে রানুর কাছে এলো।
– আঁচলটা এমন হয়ে আছে কেন রে রানু! দেখ তো আবার একটু ঠিক করে দে।
রানুর বিরক্তি এবার চরমে। যে মেয়ে দিনরাত স্বামীর লুটুপুটুতে বেঁহুশ হয়ে যায় সে মেয়ে শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে পারবেনা- এটা মানা যায়না। রানু বলল,
– আপু তোকে আজ বাংলাদেশের জাতীয় পতার মত লাগছে। শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে করতে বললো রানু।
– মানে কি? অবাক হয়ে বীথি প্রশ্ন করলো।
– মানে কিছু না। মানে হলো তুই খুব ভালো একজন মানুষ। এত ভালো যে, মাঝে মাঝে তোকে নিয়ে কষ্ট হয়। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় তোকে গলা চিপে মেরে ফেলি।
শাড়ির আঁচল ছেড়ে মা এর ঘরের দিকে পা বাড়ালো রানু।বীথি কিছুই বুঝতে পারলনা। হা করে দাঁড়িয়ে রইলো।
রাহেলা খাতুন অতি ব্যাস্ত গাড়ীতে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র তুলায়। ছোটন আর সুরেলা ইতিমধ্যে গাড়ীতে উঠে পরেছে। বাংলার পতাকা গায়ে বীথি বার বার হোঁচট খাচ্ছে। শাড়ী পরার অভ্যাস নেই বলেই অসস্থ্যিকর পরিস্থিতিতে পরছে বার বার।
চিন্তিত মুখে রায়হান সাহেব প্রীতির মাথায় হাত রেখে পাশে বসে আছেন। গত দুইদিন মেয়েটা মাইগ্রেনের ব্যাথায় খুব কষ্ট পেয়েছে। সাথে বমিও হচ্ছিল। আজ ব্যাথা কিছুটা কমেছে তবে শরীর খুব দূর্বল। মেয়েটাকে এভাবে ফেলে যেতে রায়হান সাহেবের মন সায় দিচ্ছেনা। মন্জুরুল হক অবশ্য আছেন বলেই প্রীতিকে রেখে যেতে ভরসা পাচ্ছেন। তাছাড়া কাজের বুয়াকেও বলা আছে প্রীতির সাথে থাকার জন্য।
প্রীতি ঘুমিয়ে পরেছে। বুয়াকে পাশে বসিয়ে রায়হান সাহেব বেরিয়ে পরলেন।
গাড়ী ছুটে চলেছে বাগান বাড়ীর পথে শহর পেরিয়ে গ্রামে। বাচ্চারা খুব উৎসাহ নিয়ে পথের ধারে এটা ওটা দেখছে। সব কিছুতেই তাদের প্রশ্ন। এটা কি কাছ? এটার রং এমন কেন? ওটা কি ফল? কি ফল…. নানান প্রশ্ন।
রানু গাড়ীর জানালায় মুখ বের করে আছে। তার শীতল দৃষ্টি যেন আকাশের স্থিরতাকেও হার মানাচ্ছে! কি যেন এক অস্বস্থ্যিবোধ তাকে ঘিরে ধরেছে, ঠিক বুঝতে পারছেনা।
রায়হান সাহেব লক্ষ্য করলেন ব্যাপারটা। মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
–কি রে রানু! প্রীতির জন্য ভাবছিস বুঝি?
আশ্চর্য্য! বাবা কি করে বুঝলেন! মাও কখনো এতটা মনের গভীরে পৌছাতে পারেননি আজ পর্যন্ত, কিন্তু প্রতিবার মনের প্রতিটা উৎকন্ঠা বাবা কি করে যেন টের পান! রানু বলল,
– বাবা।তুমি যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাদের একজন, তা কি জানো?
– নাহ! জানতাম না, তবে আজ জানলাম।
বলেই রায়হান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। রানুর ভাবনায় তখনো প্রীতিলতা।
পর্ব-৩
কোথায় যে যাই….ক্ষুদ্র ফুল, বৃহৎ পৃথিবী, নীলিমায় ঘেরা নীল আকাশ…আর ওই কুহেলিকা ঘেরা কানন। দুঃখবিলাসী রানুর ছায়া তিলেক বিরহে ছুঁট তেপান্তরের মাঠে। ওদিকে মাঠ ভরা হরিণের দল ছুঁটে তার চোখের জমিনে। নিকশ আঁধারে জ্বোনাকীর আলোয় প্রস্ফুটিত চাঁদমুখে,গালে চিকচিক করা অবৈধ সঙ্গী অশ্রুবিন্দু। কালজয়ী সঙ্গীতে সুর মিলাতে মিলাতে বড্ড ক্লান্ত লাগে আজ রানুর। রাত জাগা নৈশব্দের সাক্ষী ওই দুরন্ত প্রহেলিকা খুঁটে খুঁটে খায় রানুর বিবেককে। অন্তরদাহে বৃষ্টির ছমছম শব্দ আর বাতাসে পাতার শব্দ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়!
শ্বাশত চির সত্য যা, তবু মর্ম বেদনায় প্রাণ কাঁপে কেন আজ? কেন যে মেনে নেয়া যায়না! ফেলে দেওয়া যায়না! ভালবাসা, বন্ধন বুঝি এটাই, ভাবতে ভাবতে রানুর চোখ জলে ভরে এলো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জ্বানালার পাশ থেকে সরে এলো রানু। বিছানায় আধাশোয়া হয়ে শুয়ে গায়ের উপর কাঁথাটা টেনে দিল। পাশে রাখা বইযটা চোখে পরতেই মনে হল, মলাটের ভিতর পরে আছে একটা ছোট একটা চিঠি! কয়েকটা লাইন মাত্র, অথচ কি অদ্ভুত এক যাতনা মিশে আছে চিঠিটাতে! যতবার পড়ে ততবারই রানুর বুকে কি যেন এক অসীম শুন্যতা টের পায়। আবারো মলাট খুলে সেই চিঠিটা পড়তে লাগলো রানু।
রানু,
কি দিয়ে ভালবাসা জানাই? বুঝতে পারছিনা। তুমি তো জানো আমি আগাগোরাই ইডিয়ট। তাই তোমার শুভ্র ললাটে শুধুমাত্র একটু হাত রেখে গেলাম।
জানি তুমি বড্ড জেদী। তোমাকে অবস্থানচ্যুত করা সম্ভব নয়। আমি অপেক্ষা করবো। তবু তুমি এসো। কোন এক শরতের আকাসের শুভ্র স্বচ্ছ বালিহাস কিংবা বর্ষার আকাসের মেঘমালা হয়ে এসো। বেলা শেষে অবেলার সাক্ষি হয়েই না হয় এসো। যদি মন কাঁদে একাকী তবে চলে এসো বৃষ্টির কোন এক সন্ধায়। ভুল করে ভুল ক্ষনেই না হয় চলে এসো। সময়কে হাতের মুঠোয় বন্ধি করে চির সবুজের গায়ে লেগে থাকা শিশির বিন্দুর মতই আমি তোমার অপেক্ষায়…………।
ইতি,
শুভদা
চিটিঠা পড়ে রানু আবারো সেই একই নিয়মে বুকে হাত চেপে নিঃশ্বাস নিল কিছুক্ষন। এই চিঠি সেই চিঠি নয়। এই চিঠি রানুর বুকে ভূত্বকের দূর্বল ছিদ্রপথে হামাগুঁড়ি দিয়ে জেগে উঠা অগ্ন্যুৎপাত, যেখানে বুক ভেঙ্গে বায়বীয় পদার্থের মেঘ তৈরি হয় রোজ।
*
প্রীতির প্রতি রানুর ভালবাসার কমতি নেই। সুযোগ পেলেই রানু দিনের অনেকটা সময় প্রীতির সাথে কাটায়। দুই বোন মিলে কি যেন ছাই পাশ করে। হেসে কুটি কুটি হয়। রাহেলা খাতুন তার কিছুই বুঝতে পারেন না। তবে ভালো লাগে মেয়েদের এমন খুঁনসুঁটি দেখতে। মাঝে মাঝে চোখ জলে ভরে উঠে রাহেলা বেগমের। রোজ নামাজে বসে আল্লাহ পাকের কাছে দুই হাত তুলে শুক্রিয়া জানান তার ছোট কুড়েঘরটিকে ভালবাসায় ভরে দেয়ার জন্য।
তবু মনে দুশ্চিন্তা আসে। প্রীতির জন্য আসে। রানুর জন্য আসে। মায়েরা বুঝি এমনই হয়! শত সুখে থেকেও সন্তানদের জন্য ভাবনার শেষ নেই।
গত মাসে একটা ভাল সমন্ধ এসেছে রানুর। ছেলে নিউ জার্সিতে একটা কলেজ এ শিক্ষকতা করে। এক মায়ের এক ছেলে। কিন্তু রানু কে রাজি করাবে কে? বড্ড জেদী মেয়েটা। তার উপর বাপ তো আছেনই সোহাগ দিয়ে মেয়েকে আরো মাথায় তুলতে!
বীথি তার পরিবার নিয়ে বাহিরে শপিং এ বেরিয়েছে। প্রীতিও সাথে গেছে। রায়হান সাহেব বসে আছেন তার প্রিয় ইজি চেয়ারটায় দুইদিন পুরানো খবরের কাগজ হাতে নিয়ে। সময় পেলেই তিনি পুড়ান খবর ঘাটেন। কেন ঘাটেন, তার রহস্য আজো খুজে পাননি রাহেলা খাতুন। ভাত বাড়া পুড়নো চালের সাথে পুড়ানো খবরের কি সম্পর্ক সে রহস্য উন্মোচন করতে করতে ২৭ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি একই বিছানায়। রহস্য আজও উন্মোচন হয়নি।
রানু অন্ধকার ঘরে শুয়ে রবীন্দ্র সংগীত শুনছে। রাহেলা খাতুন ঘরে ঢুকে বাতিটা জালিয়ে দিলেন।বললেন,
– কিরে মা! অবেলায় শুয়ে আছিস যে! বলেই তিনি মেয়ের বিছানায় বসলেন
– এমনি মা। রানু মা এর কোমর জড়িয়ে ধরলো।
–একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম রে মা। রাহেলা খাতুন ইতস্তত ভাবে রানুর মুখের দিকে তাকালেন।
– হুম বলে ফেলো। তখনো রানু মা এর কোমর জড়িয়ে আছে।
– বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস? সমন্ধটা হাত ছাড়া হয়ে গেলে…!
রাহেলা খাতুন আর এগুলেন না। এখানেই থেমে গেলেন। ততক্ষনে রানু উঠে বসেছে।
– মা! আমি তো বিয়ে করবোনা। জানো তুমি। তবে কেন একি কথা নিয়ে আবারো……… !
কথাটা শেষ না করেই থেমে গেলো রানু।
– এটা কি হয় রে রানু?
– হয়। খুব হয়। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা। আমি আর প্রীতি দুই বোন এক সাথে থাকবো সারা জীবন।
– একদিন আমরা থাকবোনা রে মা। মেয়েদের একটা ঘরের প্রয়োজন হয়। একা থাকা যায় না। অসহায় চোখে রাহেলা খাতুন তাকালেন মেয়ের দিকে।
– কেন? একা কেন? আমি আর প্রীতি। দুই বোন আছি নাহ! আমি চলে গেলে প্রীতির কি হবে? একদিন তোমরা থাকবেনা। সেদিন আমি আর প্রীতি দুই বোন মিলে এক সাথে ঘুরে বেরাবো। সন্ধার মুখে আমাদের বারান্দায় বসে চা খাবো আর তোমাদের ছবি দেখব এ্যালবাম মেলে।
– দুই দুইটা উপযুক্ত মেয়েকে এভাবে রেখে যাবো? রাহেলা খাতুনের মুখে অসহায়ত্ব এবার স্পষ্ট।
– হুম রেখে যাবা। বলেই রানু আবার রবীন্দ্র সংগীতটা ছেড়ে দিলো।
রাহেলা খাতুন এবার আর কথা বাড়ালেন না। উঠে দাড়ালেন। তিনি জানেন মেয়ে তার বড্ড একরোখা। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
*
সময় প্রবাহমান। নিজের গতিতে চলতেই থাকে। মানুষ ও সেই সময়ের সাথে ভেসে যায় এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে। পিছনে ফেলে যায় কিছু সুখ, দুঃখ বিজরিত মুহুর্ত। প্রতিদিন আমাদের এই বেঁচে থাকার লড়াই প্রকৃতির সাথে, সমাজের সাথে, পাওয়া না পাওয়া আর মিথ্যা ও সমঝোতার সাথে।
জীবনের বাস্তবতা বড় কঠিন। মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী চলেনা। একেক সময় একেক দিকে এঁকে বেঁকে চলে। নদীর স্রোতকে যেমন নিয়ন্ত্রন করা যায়না, জীবনের গতিকেও নিয়ন্ত্রন করা যায়না। আমরা অনেক সময় নিজের জন্যই কেবল বেঁচে থাকি। কিছুটা স্বার্থপর এর মত। আমরা কি চেয়েছি, কি পেয়েছি… সেটাই যেন মুখ্য বিষয়। কখনো কখনো আমরা পৃথিবীর সমস্ত শক্তি দিয়েও মনের অবাধ বিচরণকে স্থির করতে পারিনা। অনেক অসম্ভব চলাচলকেও পৃথিবীর মানুষ স্থির করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু পারেনি কল্পনার সাগরে মানুষের মনের অবাধ বিচরণকে স্থির করতে।
মায়া ভয়ংকর এক পিছুটান। এক অসীম দায়ীত্ব। এই ক্ষুদাতুর দুনিয়ায় এক পাল শকুনের মুখে প্রীতিকে একা ছড়ে দেয় কি করে রানু! এখানে প্রতি মুহুর্তে মানুষ একে অন্যকে ছিড়ে খায়। এখানে পথে পথে অসহায়ত্ব কাঁদে। রাতের আঁধারে অমানুষ গুলো কেমন দিশেহারা পায়ে হেটে বেড়ায়। স্ব-জাতীয় দেহ পেলেই ছিন্ন ভিন্ন করে খুবলে খায়।
প্রীতিলতা….. এদের জিবে লালা জড়ানোর মতই এক সুস্বাদু খাদ্য বটে।
মানুষের কিছু কিছু কথা থাকে, কিছু আবেগমাখা দুঃখ থাকে। যা কখনো অন্যকে জানায় না ।পারলে আড়াল থেকেও সেইসব দুঃখকে আড়াল করে রাখে। এই কঠোর কষ্ট গোপনের পন্থা তার ব্যাক্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে হয়তো কিন্তু তার ভেতরটা ধীরে ধীরে মরে যায়। এই স্বল্প পরিসরে কত কি যে দেখেছে রানু! কত জোড়া চোখ যে তাক হয়ে আছে এই বধীর বোনটির দিকে। মাঝে মাঝে প্রচন্ড ভয়ে রানু কুঁকড়ে যায়। মনে হয় কোথায় যে যায়! কোথায় যে লুকিয়ে রাখে প্রীতিকে!
পর্ব-৪
বর্ষা পেরিয়ে শরতের শুরু। প্রকৃতি অনেকটাই শান্ত শীতল। চারিদিকে সবুজের সমারোহ, মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে! ভোরের শিশির ভেজা ধান, শিউলী ফুল, কোমল রোদে পুকুরে ভাসমান শুভ্র শাপলার হাসি সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন এক নতুন রুপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে আজ।
রায়হান সাহেব এর ডাকাডাকিতে রানু ঘুম ঘুম চেখে উঠে এলো। চোখ কচলে বাবার দিকে তাকাতেই দেখলো বীথি এই সাত সকালে চা এর মগ হাতে বাবার চুল টেনে দিচ্ছে। রায়হান সাহেব পরম সুখে চোখ বুঝে আছেন।
রানুকে দেখেই বীথি বললো,
– ঝটপট মুখ ধুয়ে আয়। আমরা তিনজনে মিলে হাঁটতে বের হবো। বলেই আবার বাবার চুল টানায় ব্যাস্ত হয়ে পরলো বীথি।
রানু ঘুম চোখে মাথা ঝাকিয়ে আবার ঘরে চলে গেলো।
পূব আকাশে সুর্য্য তখনো উঁকি দেইনি । অন্ধকার কেটে যাওয়ায় চারিদিকে একটা শান্ত আলোকিত ভাব। আহ ! কি চমৎকার সকাল..ভাবলো রানু।
বাড়ী থেকে নদী বেশীদূর নয়। ১০০ গজ হবে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা তিনজনই নদীর পার চলে এলো। স্বচ্ছ টলমলে জলে নদী কানায় কানায় পূর্ণ। হালকা শীতল বাতাস বইছে। সবে এখন পূর্ব দিগন্তে হলুদ লাল সংমিশ্রনে সূর্য্যি উদয়ান্ত হচ্ছে।
জীবনের যান্ত্রীকতা থেকে কিছুটা দূর, প্রকৃতির এই প্রসন্নতায় মানুষের মন কখনো কখনো উদাসী হয়ে উঠে। রায়হান সাহেবের মুখে সেই উদাসীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
রানু ঠিকই হুঝতে পারে অসহায় পিতার এই উদাসীনতা।
*
বীথি আর রানু জমির মিয়ার কেরামতি চা এর টংগে বসে আছে অধীর আগ্রহে। চোখে মুখে ভয়াবহ উত্তেজনা। জমির মিয়ার ৮ বছরের নাতি মজনু বিলাতী শিশ দিয়ে দিয়ে টুংটাং শব্দে মনের আনন্দে চা বানাচ্ছে। মজনুর নামের শেষে বিলাতী লেজ লাগানোর একটা বিশেষ কারণ আছে। মজনুর জন্মের সময় তার বাবা মালেয়সিয়ায় থাকতেন। সন্তানকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু সন্তানের নামের শেষে বিলাতী লেজ জুড়ে দিতে পেরে মহা আনন্দিত হয়েছিলেন। তবে সেই লেজ বিশিষ্ট ছেলেকে তিনি দেখে যেতে পাবেননি। মজনুর জন্মের ৬ মাস পরই তিনি রোড এক্সিডেন্ট এ মারা যান। সেই থেকেই মজনু বিলাতী তার নানার কাছে আছে।
জমির মিয়া তার বিকট দাঁত বের করে তাকিয়ে আছেন বীথি ও রানুর দিকে । রুপবতী দুইটা মেয়ে তার ধুলি পরা নড়বড়ে টুলে বসে ময়লা কাপে চা খাবে- এই বিস্ময়ে জমির মিয়ার মুখ বন্ধ হচ্ছেনা!
মজনু বিলাতীর চা বানানো শেষ।
– আপা চা রেডি! ফোঁকলা দাঁত বের করে মজনু চা এর কাপ বাড়িয়ে দিল।
চা হাতে নিয়ে কাপে চুমুক দিতেই বীথির কপাল কুঁচকে গেল। বলল,
–কি রে মজনু! এত মজার চা বানানো তোকে কে শিখিয়েছে?
– সবই আল্লাহর ইচ্ছা আপা। এবার মজনু বিলাতীর বাকি দাঁত গুলোও চকচক করে উঠলো।
–হুম। বললো বীথি।
–তুই পরাশুনা করিস না? বীথির প্রশ্ন।
– না আপা।
–কেন? নানাকে সাহায্য করেও তো তুই স্কুলে যেতে পারিস।
– সবি আল্লাহর ইচ্ছা আপা। কপালে নাই পড়ালেখা। চা বেঁইচা পেটই চলেনা। পড়াশুনা করমু কেমনে!
এবার মজনুর চোখে কিছুটা অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো।
– তুই স্কুলে ভর্তি হবি কাল। আমি তোর পড়াশোনা করাবো।
বলেই বীথি উঠে দাড়ালো। মজনু বিলাতীর মুখ হা হয়ে গেল।বিস্ময় কাটছে না! মজনু বলল,
– আপনি কেন আমারে পড়ালেখা করাইবেন আপা?
– সবি আল্লাহর ইচ্ছা রে মজনু! বলেই বীথি টংয়ের বাহিরে পা বাড়ালো।
রায়হান সাহেব ও রানু এতক্ষন ধরে চা পান করার সাথে সাথে বীথি ও মজনু বিলাতীর বাক্যালীপ শুনছিল।বীথিকে উঠতে দেখে এবার তারাও টংয়ের বাহিরে পা বাড়াল।
দুই পাশে সুন্দরী দুই কন্যার হাত ধরে রায়হান সাহেব বাড়ীর পথে পা বাড়ালেন। যেতে যেতে বীথি ভাবলো, গরীব হয়ে জন্মানো আল্লাহর ইচ্ছা কিন্তু জন্মে জীবনভর গরীব থাকাও কি আল্লাহ্ এর ইচ্ছা? মজনুর মত ছোট একটা শিশু যার হাতে থাকার কথা বই কলম খাতা, সে কেনায়ের কাপে খুঁজে বেড়াবে বেঁচে থাকার উপকরণ?
মজনু স্কুলে যাবে। একদিন মস্ত বড় অফিসার হবে, কোট টাই পরে অফিস যাবে। একদিন তার সংসার হবে, বউ হবে, সন্তান হবে। কোন এক শীতের রাতে বউ সন্তান নিয়ে মুভি থিয়েটারে বসে পপকর্ন খাবে। আলো আঁধারীর বন্ধ কামরায় দুষ্টুমির ছলে বউ এর কাঁদে মজনু বিলাতীর আংগুল ছুঁয়ে যাবে!
সময়ের সাথে বদলে যায় দিন, একদিন বদলে যাবে মজনু বিলাতির জীবনও।
*
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। স্বচ্ছ নীলাকাশে সাদা তুলার মত মেঘেদের সাথে সূর্য্যিমামার লুকোচুরি খেলা চলছে। মৃদু শীতল হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আকাশের সঙ্গে মেঘেদের লুকোচুরি দেখে রায়হান সাহেবের মনে পড়ে যায় শৈশব ও কৈশোর কাটানো এমনি কত স্মৃতির কথা! মেঘবালিকাদের সাথে মিতালী করে উড়ে যাওয়া সাদা বকেদের মত, উড়ে যেতে মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে আজ রায়হান সাহেবের।
যত অস্থিরতা আজ তার মনের আকাশে তা কেবল প্রীতিলতার জন্যই । ক্ষনে ক্ষনে মনের আকাশ বেদনায় ঢেকে যায় এক অনিশ্চয়তায়! ভাদ্র মাসের আকাশের মতই গুম হয়ে থাকে রায়হান সাহেবের মনের কষ্ট, তবু কান্না হয়ে কাউকে ভিজিয়ে দেয়না।
এমনি নানান ভাবনায় যখন রায়হান সাহেব বিচলিত, তখনি ঘারের কাছে তিনি কারো উপস্থিতি টের পেলেন। বিমর্ষ রায়হান সাহেব ঘোর কাটিয়ে ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলেন! কিছু বুঝার আগেই প্রীতিলতা বাবার কোলে ঢলে পড়ল।
পর্ব-৫
গতকাল থেকে প্রীতির শরীর খুব খারাপ যাচ্ছে। চোখ মুখ শুকিয়ে গর্তে ঢুকে গেছে। মেয়েটা কিছুই মুখে দিচ্ছেনা। বেশ কয়েকবার বমিও হয়ে গেলো। ডাক্তার কাকা এসেছিলেন কাল রাতে। হার্টবিট, ব্লাড প্রেসার আর পালসরেইট দেখে রায়হান সাহেবকে বলে গেলেন সময় করে আজ বিকেল নাগাদ একবার যেন তার চেম্বারে আসেন।
দেখতে দেখতে প্রায় আড়াই মাস হয়ে গেলো। বীথিদের যাওয়ার সময় ও চলে এলো। মেয়ের চলে যাওয়ার কথা মনে এলেই মন ভীষণ ভার হয়ে যায় রাহেলা খাতুনের। এটাই নিয়ম। মেয়ের সংসার ফেলে তো আর সারাজীবন এখানে ধরে রাখা যায়না। তাছাড়া বাচ্চাদের ও স্কুল আছে। সুরেলা প্রি-কে আর ছোটন কিন্টারগার্ডেন এ পড়ে। এমনিতেই ওদের পড়াশোনা ও স্কুলের ক্ষতি হচ্ছে দেশে এসে।
রাহেলা খাতুন মেয়ের জন্য কিছু নকশী কাঁথা করেছেন। প্রীতি নিজ হাতে একটা করেছে বীথিকে দিবে বলে। রান্নার সব ধরনের মশলার প্যাকেট করে রেখেছেন রাহেলা খাতুন। কয়েক ধরনের শুটকি ও প্যাকেট করেছেন মেয়ে জামাইয়ের জন্য।ওখানে সব কিছুর খুব দাম। বীথি বলেছে খাটি সরিষার তেল দিতে দুই বোতল। রায়হান সাহেব মেয়ের জন্য সরিষা ভাঙিয়ে তেল করে রেখেছেন।
আজকের সকালটা খুব ফুরফুরা। সকাল থেকেই ঝকঝকা রোদ দেখা যাচ্ছে। আকাশ পরিস্কার । নীলে আর সাদায় মিলে ভীষণ রকমের এক সচ্ছতা। রাহেলা বেগম খুব যত্ন করে আজ সকালের নাস্তা বানিয়েছেন। ঘি ভাঁজা পরোটা, সাথে মিশ্র সবজি ভাজি আর পায়েস। ছোটন আর সুরেলাও ততদিনে বাঙ্গালী নাস্তা খাওয়া শিখে গেছে।
সবাই খেতে বসেছে এক টেবিলে। রাহেলা খাতুন খুব যত্ন করে সবার প্লেটে নাস্তা তুলে দিচ্ছেন।
মায়ের হাতের পায়েস করা বীথির খুব পছন্দ। বীথি পায়েস মুখে দিতে দিতে বললো,
– মা! তুমি যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাধুনী, এটা কি জানো?
রাহেলা বেগম অবাক চোকে তাকালেন মেয়ের দিকে। মনে হল যেন মেয়ে তাকে হ্যালোয়েলস গ্রিন মাম্বার সাথে সেল্ফি তুলতে বলছে। বীথি বলল,
–হ্যা মা। তুমি খুব ভাল রাঁধো। বিদেশে থাকাকালীন তোমার হাতের রান্না খুব মিস করি।
রাহেলা বেগমের চোখে পানী চলে এলো। মেয়েরা ভালবাসার কথা বললেও তিনি কাঁদেন, মেয়েরা ধমক দিলেও তিনি কাঁদেন। অনেকটা হাতি পশুর মত। হাতি যদিও কাঁদে কিন্তু সেটা কি শুধুই মানব শিশুদের মত অবুঝ কান্না নাকি আবেগের কান্না তা নিয়ে যেমন অনিশ্চয়তা আছেন পশু বিশেষজ্ঞরা, তেমনি রাহেলা খাতুনের কান্না নিয়েও বিভ্রান্তিতে থাকেন তার মেয়েরা।
*
সেই কখন থেকে রায়হান সাহেব আর রানু বসে আছে ডাক্তার বাবুর চেম্বারে। এক ঘন্টা হলো প্রায়। প্রীতি নখ খুঁটে খুঁটে দূর্বল চোখে এদিক ওদিক দেখছে।
রায়হান সাহেবের হাতে দুটি পানির বোতল। একটি বোতল তিনি প্রীতির দিকে এগিয়ে দিলেন।
– পানি খাবি রে মা?
প্রীতি মাথা নেড়ে না জানালো।
– তুই খাবি রানু?
রানু হাত বাড়িয়ে পানির বোতলটি নিলো। ঢগঢগ করে প্রায় আধা বোতল শেষ করে ফেললো।
রানুর অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। কিসের অস্থিরতা ঠিক বুজতে পারছে না। মনে হচ্ছে শৈত্য প্রবাহে কোথাও কিছু একটা জমে যাচ্ছে। আবার প্রচন্ড তাপে সেই জমে যাওয়া কিছু গলে গলে পরছে।
পর্দা সরিয়ে ডাক্তার বাবুর এসিস্ট্যান্ট রায়হান সাহেবের দিকে হাত নেড়ে ভিতরে যেতে বললেন । রায়হান সাহেব ভয়ার্ত মুখে ভিতরে ঢুকলেন। পিছু পিছু রানু। রানুর অস্থিরতা আরেক ধাপ বেড়ে গেলো! কুকুরের মত নাকের ডগায় একটা দুর্গন্ধ টের পেলো। ডাক্তার বাবুলখুব সরল ভাবে বললেন,
– যা ভেবেছিলাম তাই
– কি ভেবেছিলেন? রায়হান সাহেব উদ্ধিগ্নতা বেড়ে গেল। রানু কান সোজা করে শুনছে ডাক্তার বাবুর কথা। বুক ধুকধুক করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি প্রচন্ড তাপে কিছু একটা গলতে শুরু করেছে। রানুর সমস্ত শরীর ঝাঁকানি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সামনের ডাক্তার বাবু, চেয়ার টেবিল, স্টেথিস্কোপ, পানীর বেতল…. সব থেতলে যাচ্ছে।
*
সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় জীবন।বদলে যায় জীবনের রথ। সেই সাথে সুকৌশলে বদলে যায় সারথী, বদলে যায় আরোহী। শুধু বদলায় না মস্তিষ্কের কোন এক গোপন কুঠুরীতে ঘাপ্টি মেরে থাকা বহু পুরাতন স্মৃতি। হাজার চেষ্টায় ও সে স্মৃতিকে অস্বীকার করা যায়না। সরানো যায়না। তেমনি একটা স্মৃতি আজ বার বার রানুর মনকে অস্থির করে তুলছে। তখন রানু ক্লাস সেভেন এ পড়ে। গ্রাম থেকে ছোট মামা এসেছেন তার দলবল নিয়ে শহরে ডাক্তার দেখাবেন বলে। সব মিলিয়ে উনারা সাত জন । রাতে এক রুমে গাদাগাদি করে সবাইকে ঘুমানোর ব্যাবস্থা করেছেন রাহেলা খাতুন। শীতের রাত। পর্যাপ্ত লেপ বা কম্বল না থাকায় সবায় ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন । রানু সবার ছোট বলে তার কম্বলটিও দিয়ে দেওয়া হলো ছোট মামার পরিবারকে। সেই রাতের জন্য রানুকে বলা হলো প্রীতির সাথে কম্বল ভাগ করে ঘুমাতে। যথাবীতি রানু গেলো প্রীতির সাথে একি কম্বল ভাগ করে ঘুমুতে। সেই রাতে একটু বেশীই যেন শীত বেড়ে গেলো। হঠাৎ প্রীতি লক্ষ্য করলো রানু ঠঁক ঠঁক করে কাঁপছে। কপালে হাত রেখে প্রীতি ভীষণ চমকে গেলো। একি! গা তো পুড়ে যাচ্ছে রানুর! এত রাতে মা’কে আর না ডেকে নিজেই কাপর ভিজিয়ে বাটিতে করে নিয়ে এলো। গায়ের কম্বলটি দু’ভাজ করে রানুর গায়ে পেঁচিয়ে দিয়ে রাতভর ছোট বোনের কপালে ভেঁজা কাপর দিয়ে মুছে দিতে লাগলো। রানু শুধু শক্ত হাতে প্রীতিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।
কত কথা আজ স্মৃতির ক্যানভাসে যে ভেসে উঠছে রানুর! চোখের কোনে মুক্তদানা গুলো ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে দু’গাল বেয়ে। কেন এমন হয়? মানুষের জীবন আসলেই নদীর মতো। নদীর বাঁক পরিবর্তনের মতোই মানুষের জীবন বারবার নতুন দিকে মোড় নেয়। নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে মানুষের জীবন।জীবনের অনেক কিছুই হঠাৎ বদলে যায় কোন আগাম সংকেত ছাড়াই। কেন বদলে যায়? জানতে চেয়েও জানা হয়নি জীবনের এই কঠিন রহস্য।
চোখের পানীগুলো মুছে নিয়ে রানু এগিয়ে গেলো প্রীতির ঘরের দিকে। প্রীতি শুয়ে আছে এক কাত হয়ে। ভীষণ দূর্বল আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে প্রীতিকে।
– আপু। রানু ডাকলো।
ঘুরে মুখ ক্লান্তিতে ফিরে তাকাল প্রীতি।
– তোর সাথে কিছু কথা আছে। বলেই ঘরের দরজাটি হুট করে বন্ধ করে দিলো রানু।
পর্ব-৬
আজ মেঘদূত নিয়েছে আড়ি। সেই সকাল থেকে ক্রমাগত বৃষ্টি হচ্ছে। থামার কোন নাম নেই। বৃষ্টির সাথে প্রেম-বিরহ ও মন খারাপের কেমন যেন একটা অনড় সম্বন্ধ রয়েছে। বৃষ্টি চিরকালই আমাদের হ্নদয়ে আছড়ে দেয় এক পশলা স্মৃতি। বিশুদ্ধ বৃষ্টি জলে ভিজে যে মেয়েটি হেসে কুটি কুটি হয়, সে আজ জলের আত্মচিৎকারে জ্বলে যেতে চায়। শুভদা একদিন বলেছিল, রানু! আকাশ কেন কাঁদে জানো?? রানু বলেছিল, না। শুভদা তখন বলেছিল, শোন রানুনি। মাটির বুকে মিশে যেতে আকাশ কাঁদে। আমিও কাঁদি আকাশের মত, ঠিক তোমার মাঝে মিশে যেতে।
রানু সেদিন কিছু বলেনি। শুধু সূর্যাস্ত দিগন্তে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, শুভদা! সন্ধ্যা হয়ে এল। আমি যাই।
তারপর প্রায় মাস গেল। শুভদা আর এলো না। অভিমান, না অনুযোগ ঠিক বুঝে উঠেনি রানু। তারপর হঠাৎ একদিন জানতে পেল, শুভদা উচ্চশিক্ষায় দেশের বাহিরে চলে গেছে। কি যে ভীষণ ক্ষরতাপে জমিন ফেঁটে সেদিন আগ্নেয়উত্তাপ আকাশ বাতাস সব দূষণ করে দিচ্ছিল! মনে হচ্ছিল সে উত্তাপে পৃথিবী পুড়ে যাচ্ছিল।
তারপর নীল খাম হাতে বন্ধ ঘরে খাতা টেনে বসেছিল রানু। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে লিখেছিল,
শুভদা,
তুমি তো অনেক কিছু জানো। বলতো বুকের কোন পাশটায় কষ্ট জমে থাকে? ডানে না বামে? আমার আজ দু’পাশেই খুব ব্যথা।
শুভদা, তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, ভরা পূর্নিমায় তোমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখব। লিখবো লিখবো করে কত রজনী গিয়েছে কেটে বর্ণমালায় সুঁই সুতো গুঁজে শব্দের মালা আর গাঁথা হয়নি। ফাগুনে ফাগুনে কতবার গাছের পাতা গিয়েছে ঝড়ে, কত বসন্তে কদমের ঘ্রাণে ধরনী উঠেছে কেঁপে! ভরা পূর্নিমায় অলৌকিক ইন্দু প্রভায় মানব সভ্যতা কতবার মেতেছে উল্লাসে তবু, তোমাকে একটা কবিতা লিখা হয়নি।
শুভদা, মুক্তস্বরে আমার আর্তনাদ শুনতে কি পাও?
আকাশের বুক ফুঁড়ে দেখো আজ কেমন শোকগাঁথা। বুকের ভীতর বিঁষ ঢুকেছে শুভদা। সে বিঁষে কেবল আমার দখল, এখানে তোমাকে মানায়না। জানো তো, কষ্টের দামে আমাকে চাওয়া ঘোর অপরাধ, অপরাধ। তোমাকে না পাওয়ার আকাঙ্খায় মহাকালের ঘূর্ণায়নে মনের ভিতর হু হু করে বাতাস ঢুকে। তোমার বুকে জমাট বাঁধা অভিমান উষ্ণ আলিঙ্গনে আমায় শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়। শুভদা, বলো তো, বৃষ্টিজলে ভেসে আসা ভ্রমরা মাতাল কদমের ঘ্রাণে কেন মরে? বল, বল! বল শুভদা, সকাল দুপুর বিকেন সন্ধ্যা… আমার কেন সব রাত হয়ে যায়?
শুভদা, কিছু আঁধারের কথা বলি তবে শোন! আঁধারের নগ্নতায় বিষাদের ছাপের কথা শুনেছো কখনো? কিংবা কফিনে বন্ধি উড়ে যাওয়া চিলের নৈঃশব্দিক পদচারণার কথা? শোন তবে বলি, নর্দমায় পড়ে থাকা যারজ হ্নদপিন্ডটুকু তোমার আকাশে ঘুড়ি উরাবে না। কখনোই না। বুক বেয়ে হামাগুড়ি দেয়া আমার নির্বিকার জীবন, তোমার খোঁজে কখনো আর চোখের জলে বুক ভাসাবেনা।
শুধু জেনে রেখো, কাল্পনিক স্বপ্নে আশা জাগানিয়া প্রেম, আমার জন্য নয়।
তুমি খুব ভাল থেকো শুভদা।
ইতি
রানু
সেই চিঠি নীল খামে আজও মুখ বধীর হয়ে পড়ে আছে। শুভদাকে আর দেয়া হয়নি।
*
স্মৃতির ক্যানভাসে আজ কত কি মনে পরছে রানুর। আজ তার মন খারাপের দিন। সেই সকাল থেকে রানু দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে।সারাদিন কিছু খায়নি। রায়হান সাহেব বেশ কয়েকবার দরজায় কড়া নেড়ে গেলেন।রানু সারা দেয়নি। এবার রাহেলা খাতুন দরজায় টোকা দিতেই রানু বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। এবার দরজা খুলতে হবে। নয়তো ঘোর বিপদ। না খেয়ে মেয়ে দরজা বন্ধ করে আছে এই আতঙ্কে তিনি পীর-কবিরাজ, ফু বাবা, ন্যাংটি বাবা… সব বাবাদের পালকিতে করে বাসায় তুলে নিয়ে আসবেন। তারপর শুরু হবে আগরবাতি জ্বালিয়ে ঝারফোক। আর সেই আগরবীতির গন্ধে বমি শুরু হবে রানুর।
–এই রানু! দরজাটা খুল!
রাহেলা খাতুন ডাকছেন। রানু এতক্ষন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মায়ের ডাকে সন্মোহন কেটে গেল রানুর। এবার দরজাটা খুলে দিল। রাহেলা খাতুন উদ্দিগ্ন হয়ে ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই মেয়ের দিকে কেমন বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। রানু বলল,
–মা কিছু বলবে?
রানুর দিকে খুব গভীর ভাবে তাকালেন রাহেলা বেগম। কেমন যেন অসহায়বোধ করতে লাগলেন তিনি। বললেন,
–সারাদিন কিছু খাসনি মা। শরীর খারাপ করবে। তোর যদি কিছু উলটপালট হয়ে যায়….! এমনিতেই কত বিপদ..!
রাহেলা বেগমের চোখ ভিজে উঠলো। চোখের জল লুকাতে তিনি জ্বানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
রানুর মুখে এবার সামান্য বিদ্রুপের হাসি দেখা গেল। বলল,
–মা। না খেয়ে কেউ অসুস্থ্য হয়না, মরেও না। মানুষের যত অসুখ সব মনে। মনের অসুখে মানুষ মরে, শরীর তো কাঁদা-মাটি-জলে তৈরী।
রাহেলা বেগম এবার কাছে এসে মেয়েকে ঝাপটে ধরলেন। বুক ফেঁটে তার সকল বিষাক্ত নিঃশ্বাস যেন চোখের জলে গড়িয়ে পরতে লাগলো। রানুর বুকের মধ্যে কেমন গিঁট লাগতে শুরু করলো। মনে হল ডায়াফ্রাজম কাজ করছেনা। ফুসফুসের অভ্যন্তরিন অতিক্ষুদ্র অ্যালভিওলাস কোষগুলোর গণহারে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে! ফুসফুস খুব দ্রুত সন্চালনে ব্যস্ত। রানু আরো বেশী করে রাহেলা খাতুনকে বুকে চেপে ধরলো।বিক্ষিপ্ত মনে বিরবির করে বলতে লাগলো, মা! রাস্তা থেকে কুঁড়িয়ে এনে যেই অসাড় শিশুটিতে তুমি নিজ বুকে ধরে পরিবার দিয়েছো, সমাজে অবস্থান দিয়েছো, আত্মনির্ভরশীল হতে ভালবাসা ও সাহস দিয়েছো, সেই শিশুটি আজ শিশু নেই, সে আজকের রানু; তোমার রানু। তোমার এই চোখের জলের পরিনাম তাকে ভোগ করতেই হবে মা।
শেষ পর্ব
কাল সারারাত ঘুম হয়নি রানুর। মৃত্যুর স্বাদ নিতে নিতে যেমন মানুষ আঁকরে ধরে পুরণো স্মৃতি, তেমনি কাল রাতভর পিপীলিকার মত হাজার স্মৃতি ঘিরে রেখেছিল রানুকে। দাদীমার কথা, শৈশব-কৈশরে পুতুলের বিয়ে, বউচি, কুতকুত, কানামাছি আরো কত কি খেলা ভেসে উঠছে আজ রানুর মনের দৃশ্যপটে!
মনে পড়ে রানু তখন পাঁচ কি ছয় বছরের শিশু। দাদীমা তখন সুস্থভাবেই বেঁচে ছিলেন। সে সময় শীত এলেই বাড়ীতে তখন চলতো অগ্রহায়ণের নতুন চালের পিঠা উৎসব। প্রায়ই আত্বীয়রা আসতেন। রাহেলা খাতুন খুব মজা করে নানান রকমের পিঠা করে তাদের খাওয়াতেন। অন্যদের খাওয়াতে রাহেলা খাতুন খুব পছন্দ করেন।
এমনই এক শীতের দিনে রায়হান সাহেবের চাচাত ভাই এলেন বাড়ীতে স্ত্রী ও ছোট দুই ছেলে নিয়ে। এক রাত্রি থাকার কথা তাদের। সারাদিন খুব আনন্দ উল্লাসে কাঁটলেও সমস্যা হল রাতে। চারজন বারতি মানুষের শোবার জায়গা হলনা। নিরুপায় রাহেলা খাতুন নিজ কক্ষটি ছেড়ে দিলেন তাদের জন্য। তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি ড্রয়িংরুমে বিছানা পেতে শোয়ার ব্যাস্থা করলেন। রায়হান সাহেব গেলেন তার মায়ের সাথে ছোট ঘরের বিছানায়।
রাত তখন প্রায় কতটা রানুর ঠিক মনে পড়ছেনা তবে সবাই যে তখন গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল, তা রানুর মনে আছে।
সব স্পর্শই কি মমতার নদীতে ভালবাসার ঢেউ তুলে? স্নেহের বাঁধনে সম্পর্ককে পোক্ত করে? না, করেনা! কিছু স্পর্শ কেবল কামনায় সিক্ত হয়। চিরসত্য যা তা অস্বীকার করা সহজ নয়। অহংকারী বীর্যবান পুরুষের পশুত্ব ঘাপ্টি মেরে থাকে দিনের আলোয়। সুযোগ পেলেই নিশিথে মাথা চারা দিয়ে উঠে ভিতরের লুকায়িত পশু। হুংকার ছেড়ে মনুষ্যত্ব হারায় বীর্যবান পুরুষ। ঢেকে দেয় এক সীমাহীন আঁধারে নারীর নারীত্ব। দুর্বার কান্নায় পাথরের চোখে জল এসে যায়, তবু সে জল স্পর্শ করেনা পুরুষের কঠিন হৃদয়। পুরুষ চিরকালই পিপাসার দাস। সেই পিপাসায় বুভুক্ষ পুরুষ ছিন্ন করেছে কত বন্ধন। চটি পায়ে মাড়িয়ে গেছে কত সদ্য ফুটে উঠা লাল- নীল -হলদে সন্ধ্যা মালতীর বাগান। তার দুর্গন্ধময় বীর্য ছড়িয়ে দিয়েছে জমিনে, কাল থেকে মহাকালে। পুঁতে দিয়েছে নারীর সতীত্বকে হাজার গজ জমিনের গহীনে যেখানে উর্ভর মাটি শেষে কেবল অনুর্ভর কীট-পতঙ্গ মাটি আঁকরে বেড়ে উঠে। রানুর ভাব্লেশহীন মুখে কোন ক্রীয়া- প্রতিক্রীয়া নেই আজ। যেন তার অন্তরাত্মা জানে ভবিষ্যৎ! ভাবতে ভাবতে শীতল চোখে রানুর এক ঝলক আনন্দের হাসি খেলে যায় হঠাৎ।
*
রায়হান সাহেব কে ঘুমের ঔষদ দেয়া হয়েছে। প্রেসার অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। রাহেলা বেগম স্বামীর পাশেই বসে আছেন। মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। বীথি তার জিনিস পত্র গোছাতে ব্যাস্ত। আর মাত্র ৩ দিন। বীথি ফিরে যাচ্ছে তার দেশে।
– আসবো আপু? দরজায় দাঁড়িয়ে রানু জিজ্ঞেস করলো।
– আয়। বীথি কাপর গুছাতে গুছাতেই বললো।
– আপু।
– হুম।
– তোকে আমি খুব বেশী রকমের ভালবাসি। রানু বললো।
– জানি রে পাগলী। আমিও তোকে খুব ভালবাসিরে রানু। বলেই বীথি ঘুরে দাড়ালো। দু’হাতে রানুকে জড়িয়ে ধরলো। বীথির চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। রানু দু’হাতে বোনের পিঠ আঁকড়ে ধরে বললো,
– পৃথিবীর নিয়ম খুব বিচিত্র। তুই কি জানিস আপু ভালবাসার মানুষ গুলোকেই আমরা সবচেয়ে বেশী কষ্ট দেই?
রানুর ভিতরের শক্ত জমে যাওয়া কিছু একটা যেন আবারো গলতে শুরু করেছে। অলক্ষে চোখের জল গড়িয়ে পরছে। দু’বোনের ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলে গড়ে উঠছে এক জল ভরা দীঘি। কেউ জানেনা কার ব্যাথা কিসে। একি দীঘিতে কষ্টের নোনাজলে টই টুম্বুর। শুধু সেই জলের স্বাদ ভিন্ন।
রানু এবার শক্ত করে বোনকে চেপে ধরলো। বিরবির করে বলতে লাগল, আমায় ক্ষমা করিস আপু। আমি তোকে খুব ভালবাসি।
*
দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয় নাশক দুর্গা যেন আজ শশরীরে নেমে এলো ধরনীর বুকে। দুর্গম নামক অসুরকে বধ করতে মা দুর্গার হাত কাঁপেনি। মহিষাসুর কে পরাস্ত করে করে পাপমুক্ত হতেও তার হৃদয় কাঁপেনি। কতভাবেই না মহিষাসুর নিজের প্রাণ বাঁচাতে দুর্গার শক্তিকে ব্যহত করতে চেয়েছেন। কখনো মহিষের বেশে, কখনো সিংহ বা হাতীর বেশে। কিন্তু প্রতিবারই দুর্গা তার প্রতিবাদী তলোয়ারের ঝংকারে হয় গলা থেকে মাথা কেটে আলাদা করে দিয়েছেন, নয় সূড় কেটে পরাশক্তির শক্তিকে বধ করেছেন। শুভ শক্তির কাছে অশুভ শক্তির পরাজয় নিশ্চিত।
ভোরের কাঁক তখনো ডাকতে শুরু করেনি। চারিদিকে আলো আঁধারীর এক অস্পষ্ট খেলা। প্রকৃতি আজ ভীষণ শান্ত। মাঝে মাঝে কিছু শুকনো পাতার মরমর ধ্বনি। আর নিন্মসুরে চাপা এক করুন সানাইয়ের ধ্বনি বেজে চলেছে। বাড়ীময় এক নিষ্ঠুর নীরবতা।
রায়হান সাহেব হত বিহব্বল। তার দৃষ্টিতে কোন ভাবের লেশ নেই।পৃথিবীর নিষ্ঠুরতায় তিনি বাকরুদ্ধ। রাহেলা খাতুন জ্ঞান হারিয়ে পরে আছেন বিছানায়। প্রীতিলতা গভীর মমতায় মায়ের মুখে চোখে পানির ছিটা দিচ্ছেন। এই মুহুর্তে মা’কে সারিয়ে তুলাই যেন মুখ্য। বীথি দুই ছেলে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদে যাচ্ছে। বিস্ময়ে বাচ্চারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছেনা। কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই তাদের বোধগম্য নয়।
পাশের ঘরেই রানু তাকিয়ে আছে মন্জুরুল হকের দিকে। কি ভয়াবহ শান্ত দুটি চোখ তার আজ! নিষ্ঠুরতার জলজলে চোখে এক তৃপ্তির আভাস। ঠোঁটের কোনে ঈষৎ হাসি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রক্তে ভেজা বটিটা এবার মাটিতে ছুড়ে ফেললো রানু। পাশেই রক্তে ভেসে যাচ্ছেন মঞ্জুরুল হক।
পাপকে একদিন বাঁচিয়ে রাখা মানে পৃথিবীর একদিনের ক্ষয়। পাপকে চিরতরে তৎক্ষণাৎ নির্মুল করে দিতে হয়!তবেই না ধরনী শান্ত হয়!
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত জীবের দুর্গতি হরণ করার জন্য আবির্ভাব হয়েছিল দেবী দুর্গার। তেমনি শ্রষ্টা নতুন রুপে দুর্গার পুন-আবির্ভাব ঘটালেন রানুকে দিয়ে। রানুর আরেক নাম হয়ে গেলো দুর্গা।
রানুর ইতিকথা- পর্ব ১-৬
পর্ব-১
আষাঢ় মাসের দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। এ সময় সাধারণত আকাশ মেঘলা থাকারই কথা। কিন্তু এখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে রায়হান সাহেব বগলের তলে রাখা ছাতাটা মেলে ধরলেন মাথার উপর। আরেক হাতে তার বাজারের ব্যাগ। পায়জামাটা হাঁটুর কাছে ভাঁজ করে তুলেই তিনি ছপ ছপ পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন মেইন ফটকের দিকে।
মনে মনে ভাবছেন, আজ কি বাজার করা যায় ! প্রায় ৮ বছর পর আজ তার বড় মেয়ে বীথি এসেছে বিদেশ থেকে। সাথে জামাই ও দুই ছেলে মেয়ে ছোটন এবং সুরেলা । বৃষ্টির দিনে বীথি ভুনা খিচুরী আর গরুর মাংস খুব পছন্দ করতো। তাহলে সেটাই নেয়া যাক।
কিন্তু যদি মেয়ের শখ এতদিনে বদলে গিয়ে থাকে! কে যানে! হয়তো এখন ভুনা খিচুরী আর গরুর মাংসের বদলে বৃষ্টির দিনে তার মেয়ে সী-ওইড কিংবা আফ্রিকান লাং ফিশ খেতেই বেশী পছন্দ করে।
রায়হান সাহেব এর কপালে আরেকটা বিরক্তির ছাপ পরলো। নিজ মনে বিড়বিড় করতে করতেই তিনি বাজারের দিকে ছুটলেন।
রায়হান মুস্তফা। একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা। তিন মেয়ে বীথি, প্রীতি ও রানু। কোন ছেলে সন্তান নেই উনার। স্ত্রী রাহেলা খাতুন। কিছুটা ওজনদার হলেও অত্যন্ত দায়ীত্বশীল ও মায়াবী মনের একজন স্ত্রী রাহেলা। তিন মেয়েকে বলতে গেলে রাহেলা খাতুনই আদর যত্ন ও শাসনে রেখে মানুষ করেছেন। যদিও তিন মেয়েই আড়ালে আড়ালে বাবার বেশী ভক্ত।
রায়হান সাহেবের তিন মেয়েই অসম্ভব রুপবতী ।এইচ এস সি পাশ করার পরই বীথির বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী মন্জুরুল হক, বড় সাদাসিধা ঘরকুণো টাইপ ভদ্রলোক ।
প্রীতি, রায়হান সাহেব ডাকেন প্রীতিলতা বলে বাকহীন বধীর বলে স্কুলের চৌকাঠ মাড়ানো হয়নি। অথচ এই মেয়েটিই রায়হান সাহেবের সব চেয়ে রুপবতী ও গুনবতী মেয়ে।
সবার ছোট রানু। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকসে অনার্স করছে ফাইনাল ইয়ার।
চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার পর পেনশন এর টাকা ও বাড়ী ভাড়া দিয়েই রায়হান সাহেবের সংসার চলে যায়। একতলা ও দুইতলা ভাড়া দেয়া। নিজেরা থাকেন তিন তলায়।আর সময়ে অসময়ে এমেরিকা প্রবাসী মেয়ে বীথি তো আছেই।
*
আজ ভুনা খিচুরী আর গরুর মাংস রান্না করেছেন রাহেলা খাতুন। কতদিন পর তিন মেয়েকে এক সাথে নিজ হাতে বেরে খাওয়াচ্ছেন । মঞ্জুরুলকে একটু বেশীই সমাদর করে খাওয়ানো হচ্ছে। জামাই বলে কথা! বীথি গরগর করে অনর্গল তার এমেরিকার গল্প করেই যাচ্ছে। রাহেলা খাতুন এর এই মেয়েটি একটু বোকা টাইপের। অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে গুলো বোকাই হয় ।
ছোটন আর সুরেলা বসেছে রানুর দু’পাশে ।পরম আদরে রানু ওদের মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে।
রাহেলা খাতুন হঠাৎ লক্ষ্য করলেন প্রীতি কেবল তার প্লেটের খাবার নেড়ে চেড়েই যাচ্ছে। মুখে দিচ্ছেনা।
–কি রে মা, খাচ্ছিস না যে ! ভাল হয়নি বুঝি ? বলেই রাহেলা খাতুন এগিয়ে গেলেন প্রীতির দিকে।
প্রীতি মাথা ঝাকিয়ে জানালো যে খাবার ভাল হয়েছে। তারপর এক হাতে মা এর কোমর জড়িয়ে ধরেই আস্তে আস্তে খেতে লাগলো। যেন মা কে ছুঁয়ে খুব অসস্থিকর কিছু একটা থেকে মুক্তি পেলো প্রীতি ।
ঝুম বৃষ্টির সাথে যোগ হয়েছে আজ বিজলী চমকানো। ছোটন আর সুরেলা তো ভয়ে অস্থির। বীথি বাচ্ছাদের পাঠিয়ে দিলো বাবার ঘরে। আজ শুধু তিন বোন গলা জড়িয়ে গল্প করবে।
*
এক খাটে তিন বোন। বীথির কোলে মাথা রেখে প্রীতি শুয়েছে। রানু তার গাল আলতো ছুঁয়ে প্রীতির পা জড়িয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে বীথির কথা শুনছে । বীথি খুব মমতায় প্রীতির চুল গুলো টেনে দিচ্ছে।
এমন সময় রাহেলা খাতুন এসে দরজায় টোকা দিলেন।
–ভিতরে এসো মা, বলল বীথি।
রাহেলা খাতুন ঘরে ঢুকলেন । মেয়েদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– চা খাবি নাকি রে মা? খাঁটি গাইয়ের দুধের চা।
প্রীতি মাথা ঝাকিয়ে জানালো সে খাবে। বীথি বলল, নিয়ে এসো মা। ৪ কাপ চা। তুমিও আমাদের সাথে খাবে আর গল্প করবে।
রাহেলা খাতুন চলে গেলেন চা বানাতে। রানু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
–আচ্ছা আপু, দুলাভাই রাগ করবেনা তুমি যে উনাকে একা ফেলে আমাদের সাথে গল্প করছো?
বীথি কিছুটা বিরক্তি সুরেই বলল, করুক। ৮ বছর গায়ে গায়ে লেগে ছিলাম। উফফ!!!
রানুর চোখে মুখে দুস্টুমী খেলে গেলো। আরেকটু কাছে বীথির গা ঘেঁসে জিজ্ঞেস করল,
– দুলাভাই কি খুব বউখেকো নাকি আপু ?
বীথির চোখ গোল হয়ে গেলো। ছোট থেকেই কোন এক বিশেষ কারণে অবাক হওয়ার মত কিছু ঘটলেই বীথির চোখ গোল হয়ে যায়।
– বউখেকো কি? গোল গোল চোখে বীথির প্রশ্ন।
– বউখেকো হচ্ছে যারা বউ বউ করে দিন রাত বউ এর আঁচল ধরে রাখে। অতি ভালবাসা বিলাতে গিয়ে বউ কে জেল খানার কয়েদী বানিয়ে দেয়। একটা নির্দিস্ট বৃত্তের বাহিরে সেই বউ পা বাড়াতে পারেনা। সেই বউ এর কাজ হচ্ছে, দিন রাত শুধু স্বামীর গদ্গদ ভালবাসা দেখে লজ্জায় লাল, নীল, হলদে রঙ ধরা। ভ্যানেটি ব্যাগের মত সেই স্বামীকে ডান হাতে ঝুলিয়ে হেলে দুলে হাঁটা।
প্রীতি খিক করে হেসে উঠলো। বীথির চোখ আরো গোল হয়ে গেলো। বলে কি এই মেয়ে। অবাক বিস্ময়কর গোলাকার চোখে বীথি বলল,
– তুই তো খুব বেশী পেকে গেছিস রে রানু!
– হি হি হি । এটাকে পাকা বলেনা আপু। এটা হচ্ছে পেকে পেকে ঝাঞ্জুরা হয়ে যাওয়া । অনেকটা সবুজ থেকে বাদামী বর্ণ ধারণ করা নারিকেল এর মত। বলেই আবার হাসতে লাগলো রানু।
মেয়েদের খুনশুটিতে রাহেলা বেগম চা এর ট্রে হাতে এসে ঘরে ঢুকলেন।
পর্ব-২
আজ দিনটা বেশ ফুরফুরা। কিছুটা রোদের ঝলকানি,সেই সাথে শীতল বাতাস। এ সময় দক্ষিনের বারান্দাটা প্রীতির খুব প্রিয়। এমন সময় প্রায়ই সে বারান্দায় বসে টুকটাক সেলাই করে। সেলাই করা প্রীতির অভ্যাস। আজও সে সুঁই সুতোয় এফোড় ওফোড় করে রংচটা নকশী কাঁথা করছে। বীথিকে দেবে বলেই গত এক মাস ধরে কাঁথা নিয়ে বসেছে মেয়েটা।
তিন মেয়ের মাঝে প্রীতিলতার প্রতি রায়হান সাহেবের মমতা যেন একটু বেশীই। হয়তো বধীর বলেই। অসহায় পিতার অনুশোচনাবোধ প্রীতিও বুঝতে পারে।
মেয়েকে অনেকক্ষন যাবত বারান্দায় দেখছেন তিনি। এমন মায়াবতী মেয়েটা কোনদিন তাকে বাবা বলে ডাকবেনা- ভাবতেই চোখ ভিজে উঠলো রায়হান সাহেবের। আজ নতুন নয়, প্রায়ই এই ভাবনাটা তাকে কষ্ট দেয়। বাস্তবতায় হামাগুড়ি দিতে দিতে তিনি ভাবলেন, মেয়েটাকে চা-টুকু দিয়ে আসি।
চায়ের কাপ হাতে রায়হান সাহেব এগিয়ে গেলেন মেয়ের দিকে। বললেন,
– কিরে মা! চা খাবি? বলেই মেয়ের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলালেন।
ঘার নেড়ে প্রীতি জানালো খাবে। রায়হান সাহেব মেয়ের হাতে চা এর কাপ তুলে দিয়ে পাশে বসলেন । প্রীতি চা এ চুমুক দিয়ে বাবার দিকে তাকালো একবার। হয়তো এতক্ষনে প্রীতি বুঝতে পেরেছে যে বাবা না খেয়ে তার ভাগের চা দিয়ে দিয়েছেন মেয়েকে।
প্রীতি দু’চুমুক দিয়েই চা এর কাপটা বাবার দিকে এগিয়ে দিলো। ইশারায় বুঝালো বাকিটা বাবার জন্য।
রায়হান সাহেবের চোখ ভিজে এলো আবারো। ভাবলেন, মেয়েটা এত মায়াবতী হয়েছে কেন! এত ভালো একটা মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনতে কার না ইচ্ছে করে! রায়হান সাহেব অশ্রুভেজা চোখে মেয়ের পাশ থেকে সরে এলেন।
বারান্দার কোনায় রাখা তার ইজি চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে রায়হান সাহেব ভাবতে লাগলেন- মেয়েটার বয়স প্রায় ২৬ ছুঁই ছুঁই। ছোট মেয়ে রানুর জন্য বিয়ের সমন্ধ আসছে। কিন্তু প্রীতিকে রেখে রানুকে বিয়ে দেয় কি করে! এই মেয়েটাকে একটা বিয়ে দিতে পারলে যেন শান্তিতে মরতে পারতেন তিনি। কিন্তু প্রীতিকে বিয়ে করবে কে! মেয়ে যে বাকহীন বধীর!
এমন ভালো একটা মেয়ে তার। তার বিয়ে হবেনা! কেউ তাকে ভালবেসে খোঁপায় ফুল গুঁজে দিবেনা! যদি তিনি না থাকেন তাহলে মেয়েটার কি হবে? এসব নানান ভাবনায় রায়হান সাহেবের বুক ভার হয়ে এল।
*
সুরেলা আর ছোটন রানুর সাথে বিছানায় শুয়ে কার্টুন দেখছে। এমন সময় রাহেলা খাতুন শাড়ীর আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে ঘরে ঢুকলেন ।
– কি দেখছিস রে তোরা? খাটে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন।
– কার্টুন মা, রানু বলল।
– বাংলা চ্যানেলটা ধর না রে মা, কি সব কার্টুন দেখিস সারাদিন!
মা’কে অস্বীকার করার উপায় নেই রানুর। সারাদিনের কর্মব্যাস্ততার পর ঘন্টা খানেক বাংলা টিভি না দেখলে রাহেলা খাতুনের ঘুম হয়না। চ্যানেল বদলে দিল রানু।
সুরেলা আর ছোটনের মুখ বাকা হয়ে গেল। দুই ভাই বোন একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। রানু কিছুটা মজা করার উদ্দ্যেশে জিজ্ঞেস করলো,
– হোয়াট ইজ দ্যা ঘটনা ভাগ্না/ভাগ্নি?
সুরেলা কপাল কুঁচকে বলল,
– ইউ ডিড নট ইভেন এ্যাস্ক আস বিফোর ইউ চেঞ্জ দ্যা চ্যানেল!
– সরি জান্টুমনি! মাই মিস্টেইক। এইবারের মত এক্সকিজ মি প্লিজ….বলেই রানু সুরেলা আর ছোটনকে কাতুকুতু দিতে লাগলো। ওরা খিল খিল করে হেসে উঠলো।
রানু মনে মনে বলল, পৃথিবীর সকল শিশুগুলির হাসি এত কিউট হয় কেন?
ওদিকে রাহেলা খাতুন এর মুখ হা হয়ে আছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আক্রমনের জন্য ব্ল্যাক ম্যামবা তার বিশালাকৃতির মুখ হা করে রেখেছে। রানু জানে তার মা’য়ের এই বিশ্ময়কর চেহারার মানে।
রানুর দিকে অবাক চোখে তাকালেন রাহেলা খাতুন। বললেন,
– একি! বড়রা চ্যানেল বদলাবে। তাতে সরি বলার কি আছে?
রানু বলল,
– মা, এটাই এমেরিকানদের নিয়ম। তুমিও সরি বলো।
– এ….কি বলছিস তুই? আমি এই পিচ্ছিদের কেন সরি বলবো? কি করেছি আমি?
রানু বুঝতে পারছে ব্ল্যাক ম্যামবা এখন ফুঁসে উঠেছে।যে কোন মুহূর্তে ছোবল বসাবে। রানু বলল,
– তুমি বিরাট এক অন্যায় করেছো মা। টিভির চ্যানেল বদলানোর আগে ওদের পার্মিশন নাওনি। এখন ওদের বলো- সরি ছোটন সোনা। সরি সুরেলা ময়না।
ব্ল্যাক ম্যামবা হঠাৎ নেতিয়ে পরেছে। রাহেলা খাতুন বললেন,
– সরি ছোটন সোনা। সরি সুরেলা ময়না।
– ইটস ওকে গ্র্যান্ডমা। ছোটন ও সুরেলা দু’জনেই বলল।
রাহেলা খাতুন সামান্য হাসি দিলেন। এই হাসি সেই হাসি নয়। এই হাসির মানে ‘যদি তোরা বাংলাদেশে পয়দা হইতি তো বুঝাইতাম কত ধানে কত চাল।”
এমেরিকানদের সাথে বাঙ্গালী পরিবারের সদস্যদের প্রায়ই কিছু প্রথা ও ভদ্রতার সংঘর্ষ ঘটে। যেমন রাহেলা খাতুন ভাবছেন, বড়রা যখন খুশী তখন যে কোন সিদ্ধান্ত নিবেন। তাতে ছোটদের পার্মিশন লাগবে কেন? এ ব্যাপারে এমেরিকাযন সংস্কৃতিতে ভিন্ন ব্যাবস্থা। সেখানে যে কোন বিষয়ে ছোটদের ও প্রাধান্য দেওয়া হয়। ওরা বিশ্বাস করেন যে, ছোটদের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হলে তাদের আত্ববিশ্বাস ও মনোবলকে জোড়দার করা হয়। ছোট থেকেই প্রতিটি শিশুর আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বৃদ্ধি না করলে, বড় হয়ে সে অকর্ম্য হয়। জীবনে সাফল্য আনতে পারেনা।
যাই হোক, ততক্ষনে রাহেলা খাতুন বাংলা ছবি দেখা শুরু করেছেন। ছবির নাম স্বামী কেন আসামী। কলকাতার ঋতুপর্না সেন দারুন উদ্দীপনায় গানের সাথে নেঁচে যাচ্ছেন। তেলাপোঁকার মত চার দিকে হাত পা ছুড়াছুড়ি করছে। রাহেলা খাতুন গভীর মনোযোগ প্রদর্শন করে দেখছেন। নাচ ভঙ্গির সাথে সাথে উনার চেহারার অবস্থানও বদলাচ্ছে।
– হোয়াই দে আর থ্রোয়িং দেয়ার আর্মস এন্ড ল্যাগস টু ইচ আদার? দাদীমাকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে আবার টিভির দিকে তাকাল সুরেলা। রাহেলা খাতুন কিছুই বুঝতে না পেরে রানুর দিকে তাকালেন। বললেন,
–এই রানু। বাংলায় তর্জমা কর।
মা’কে ছুড়ে দিয়ে রানু সুরেলাকে বলল,
– ওদের শরীরে এলার্জী হয়েছে। গা চুলকাচ্ছে । তাই এমন অস্থির ভাবে হাত পা ছুড়ছে সোনা। নো টেনশন।
– হি হি হি। দ্যা আর সো ফানি এ্যান্ট।
সুরেলা যেন খুব মজা পেলো।
এবার রাহেলা খাতুন নাত্নির প্রশ্ন সম্পর্কে অবগত হলেন। বিরক্তি নিয়ে ভাবলেন,এমন পাক্না ঝুলঝুলা মেয়ে তার মেযের ঘরে জন্মালো কি করে!
*
মঞ্জুরুল হক খাটে হেলান দিয়ে গভীর মনোযোগে ম্যাগাজিন পরছেন। বীথি ড্রেইসিং টেবিল এ তার চুল ঠিক করায় ব্যাস্ত। আড়চোখে স্বামীকে একবার দেখে নিলো বীথি।
– এই শোনো। ডাকলো বীথি।
– হুম। ম্যাগাজিন থেকে চোখ না তুলেই উত্তর দিলেন তিনি।
– বাবা বলছিলেন গ্রামে আমাদের বাগান বাড়ীতে নিয়ে যাবে। সকালে যাবো। রাতের মদ্ধেই ফিরবো। কি বলো?
–অজপারা গায়ে আমার যেতে ভালো লাগেনা। তোমরা যাও না প্লিজ, আমি বাসায় থাকি।
– বাবা কি মনে করবেন তুমি না গেলে?
– বাবাকে বুঝিয়ে বলো প্লিজ। বলেই মঞ্জুরুল হক উঠে গিয়ে বীথির কোমর জড়িয়ে ধরলেন।
– আহ! হচ্ছে কি এসব ! ছাড়ো। কেউ এসে পরবে।
বলেই বীথি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। এমন সময় রানু এসে দরজায় টোকা দিল। বললো,
– আসবো ভিতরে আপু?
– আয়। বলেই কাপরটা ঠিক করে নিলো বীথি।
রানু ট্রে তে করে দুটো পায়েস এর বাটি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। বীথিকে এক বাটি হাতে দিয়ে আরেক বাটি দুলাভাইয়ের হাতে দিয়ে বিছানায় বসলো।
– কি শালীকা, কাল নাকি বাগান বাড়ী যাচ্ছো? ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে মঞ্জুরুল হক জিজ্ঞেস করলেন।
– হুম যাচ্ছি। আপনি যাবেন না?
– নাহ। আমার কিছু প্রজেক্টের কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ করে ওদের সাবমিট করতে হবে মেইল এ। তোমরা এঞ্জয় করো।
– ওহ। বলেই রানু উঠে দাড়ালো। বীথি পায়েস খাচ্ছিলো। রানুকে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– কি রে! প্রীতির কি মাথা ব্যাথা কমেছে?
– নাহ । বললো রানু ।
– তাহলে?
– তাহলে কি? রানুর দৃষ্টিতে প্রশ্ন।
– তাহলে কাল কি বাগান বাড়ী যাওয়া হবেনা?
– ওর শরীর ভালো না হলে কি করে যাই? বললো রানু ।
– এক কাজ করা যায়। রাতারাতি প্রীতি সেরে উঠলে তো ভালই। আর না হলে, চিন্তার কিছু নাই। তোর দুলাভাই যাচ্ছেনা। প্রীতিকে দেখে রাখতে পারবে। আমরা তো রাতের আগে চলেই আসছি। বৃষ্টি বাদলার দিন। কখন আবার আবহাওয়া খারাপ করে। বাচ্ছাদ্র নিয়ে টেনশনে থাকি।
কথাগুলো বলে বীথি দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছারলো। যেন বিশাল এক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে।
– দেখা যাক। হয়তো সকালের মধ্যে সেরে উঠবে।
বলেই রানু ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। যেতে যেতে ভাবলো, আসলেই সুন্দরী মেয়ে গুলো বোকা হয়। শুধু বোকা না, ওরা যে গৃহপালিত প্রাণির মত অনুগত, সেটা বীথিকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেনা।
*
সবাই খুব সেজেগুঁজে আছে বাগান বাড়ী যাবে বলে। বীথি পরেছে লালের উপর সবুজ পাড়ের শাড়ী। সুরেলা, ছোটন কে সকাল সকাল গোসল দেওয়া হয়েছে। মঞ্জুরুল হক তখনো আধাশোয়া হয়ে বিছানায় খবর দেখছেন টিভিতে। এই নিয়ে তিনবার বীথি শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে রানুর কাছে এলো।
– আঁচলটা এমন হয়ে আছে কেন রে রানু! দেখ তো আবার একটু ঠিক করে দে।
রানুর বিরক্তি এবার চরমে। যে মেয়ে দিনরাত স্বামীর লুটুপুটুতে বেঁহুশ হয়ে যায় সে মেয়ে শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে পারবেনা- এটা মানা যায়না। রানু বলল,
– আপু তোকে আজ বাংলাদেশের জাতীয় পতার মত লাগছে। শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে করতে বললো রানু।
– মানে কি? অবাক হয়ে বীথি প্রশ্ন করলো।
– মানে কিছু না। মানে হলো তুই খুব ভালো একজন মানুষ। এত ভালো যে, মাঝে মাঝে তোকে নিয়ে কষ্ট হয়। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় তোকে গলা চিপে মেরে ফেলি।
শাড়ির আঁচল ছেড়ে মা এর ঘরের দিকে পা বাড়ালো রানু।বীথি কিছুই বুঝতে পারলনা। হা করে দাঁড়িয়ে রইলো।
রাহেলা খাতুন অতি ব্যাস্ত গাড়ীতে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র তুলায়। ছোটন আর সুরেলা ইতিমধ্যে গাড়ীতে উঠে পরেছে। বাংলার পতাকা গায়ে বীথি বার বার হোঁচট খাচ্ছে। শাড়ী পরার অভ্যাস নেই বলেই অসস্থ্যিকর পরিস্থিতিতে পরছে বার বার।
চিন্তিত মুখে রায়হান সাহেব প্রীতির মাথায় হাত রেখে পাশে বসে আছেন। গত দুইদিন মেয়েটা মাইগ্রেনের ব্যাথায় খুব কষ্ট পেয়েছে। সাথে বমিও হচ্ছিল। আজ ব্যাথা কিছুটা কমেছে তবে শরীর খুব দূর্বল। মেয়েটাকে এভাবে ফেলে যেতে রায়হান সাহেবের মন সায় দিচ্ছেনা। মন্জুরুল হক অবশ্য আছেন বলেই প্রীতিকে রেখে যেতে ভরসা পাচ্ছেন। তাছাড়া কাজের বুয়াকেও বলা আছে প্রীতির সাথে থাকার জন্য।
প্রীতি ঘুমিয়ে পরেছে। বুয়াকে পাশে বসিয়ে রায়হান সাহেব বেরিয়ে পরলেন।
গাড়ী ছুটে চলেছে বাগান বাড়ীর পথে শহর পেরিয়ে গ্রামে। বাচ্চারা খুব উৎসাহ নিয়ে পথের ধারে এটা ওটা দেখছে। সব কিছুতেই তাদের প্রশ্ন। এটা কি কাছ? এটার রং এমন কেন? ওটা কি ফল? কি ফল…. নানান প্রশ্ন।
রানু গাড়ীর জানালায় মুখ বের করে আছে। তার শীতল দৃষ্টি যেন আকাশের স্থিরতাকেও হার মানাচ্ছে! কি যেন এক অস্বস্থ্যিবোধ তাকে ঘিরে ধরেছে, ঠিক বুঝতে পারছেনা।
রায়হান সাহেব লক্ষ্য করলেন ব্যাপারটা। মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
–কি রে রানু! প্রীতির জন্য ভাবছিস বুঝি?
আশ্চর্য্য! বাবা কি করে বুঝলেন! মাও কখনো এতটা মনের গভীরে পৌছাতে পারেননি আজ পর্যন্ত, কিন্তু প্রতিবার মনের প্রতিটা উৎকন্ঠা বাবা কি করে যেন টের পান! রানু বলল,
– বাবা।তুমি যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাদের একজন, তা কি জানো?
– নাহ! জানতাম না, তবে আজ জানলাম।
বলেই রায়হান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। রানুর ভাবনায় তখনো প্রীতিলতা।
পর্ব-৩
কোথায় যে যাই….ক্ষুদ্র ফুল, বৃহৎ পৃথিবী, নীলিমায় ঘেরা নীল আকাশ…আর ওই কুহেলিকা ঘেরা কানন। দুঃখবিলাসী রানুর ছায়া তিলেক বিরহে ছুঁট তেপান্তরের মাঠে। ওদিকে মাঠ ভরা হরিণের দল ছুঁটে তার চোখের জমিনে। নিকশ আঁধারে জ্বোনাকীর আলোয় প্রস্ফুটিত চাঁদমুখে,গালে চিকচিক করা অবৈধ সঙ্গী অশ্রুবিন্দু। কালজয়ী সঙ্গীতে সুর মিলাতে মিলাতে বড্ড ক্লান্ত লাগে আজ রানুর। রাত জাগা নৈশব্দের সাক্ষী ওই দুরন্ত প্রহেলিকা খুঁটে খুঁটে খায় রানুর বিবেককে। অন্তরদাহে বৃষ্টির ছমছম শব্দ আর বাতাসে পাতার শব্দ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়!
শ্বাশত চির সত্য যা, তবু মর্ম বেদনায় প্রাণ কাঁপে কেন আজ? কেন যে মেনে নেয়া যায়না! ফেলে দেওয়া যায়না! ভালবাসা, বন্ধন বুঝি এটাই, ভাবতে ভাবতে রানুর চোখ জলে ভরে এলো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জ্বানালার পাশ থেকে সরে এলো রানু। বিছানায় আধাশোয়া হয়ে শুয়ে গায়ের উপর কাঁথাটা টেনে দিল। পাশে রাখা বইযটা চোখে পরতেই মনে হল, মলাটের ভিতর পরে আছে একটা ছোট একটা চিঠি! কয়েকটা লাইন মাত্র, অথচ কি অদ্ভুত এক যাতনা মিশে আছে চিঠিটাতে! যতবার পড়ে ততবারই রানুর বুকে কি যেন এক অসীম শুন্যতা টের পায়। আবারো মলাট খুলে সেই চিঠিটা পড়তে লাগলো রানু।
রানু,
কি দিয়ে ভালবাসা জানাই? বুঝতে পারছিনা। তুমি তো জানো আমি আগাগোরাই ইডিয়ট। তাই তোমার শুভ্র ললাটে শুধুমাত্র একটু হাত রেখে গেলাম।
জানি তুমি বড্ড জেদী। তোমাকে অবস্থানচ্যুত করা সম্ভব নয়। আমি অপেক্ষা করবো। তবু তুমি এসো। কোন এক শরতের আকাসের শুভ্র স্বচ্ছ বালিহাস কিংবা বর্ষার আকাসের মেঘমালা হয়ে এসো। বেলা শেষে অবেলার সাক্ষি হয়েই না হয় এসো। যদি মন কাঁদে একাকী তবে চলে এসো বৃষ্টির কোন এক সন্ধায়। ভুল করে ভুল ক্ষনেই না হয় চলে এসো। সময়কে হাতের মুঠোয় বন্ধি করে চির সবুজের গায়ে লেগে থাকা শিশির বিন্দুর মতই আমি তোমার অপেক্ষায়…………।
ইতি,
শুভদা
চিটিঠা পড়ে রানু আবারো সেই একই নিয়মে বুকে হাত চেপে নিঃশ্বাস নিল কিছুক্ষন। এই চিঠি সেই চিঠি নয়। এই চিঠি রানুর বুকে ভূত্বকের দূর্বল ছিদ্রপথে হামাগুঁড়ি দিয়ে জেগে উঠা অগ্ন্যুৎপাত, যেখানে বুক ভেঙ্গে বায়বীয় পদার্থের মেঘ তৈরি হয় রোজ।
*
প্রীতির প্রতি রানুর ভালবাসার কমতি নেই। সুযোগ পেলেই রানু দিনের অনেকটা সময় প্রীতির সাথে কাটায়। দুই বোন মিলে কি যেন ছাই পাশ করে। হেসে কুটি কুটি হয়। রাহেলা খাতুন তার কিছুই বুঝতে পারেন না। তবে ভালো লাগে মেয়েদের এমন খুঁনসুঁটি দেখতে। মাঝে মাঝে চোখ জলে ভরে উঠে রাহেলা বেগমের। রোজ নামাজে বসে আল্লাহ পাকের কাছে দুই হাত তুলে শুক্রিয়া জানান তার ছোট কুড়েঘরটিকে ভালবাসায় ভরে দেয়ার জন্য।
তবু মনে দুশ্চিন্তা আসে। প্রীতির জন্য আসে। রানুর জন্য আসে। মায়েরা বুঝি এমনই হয়! শত সুখে থেকেও সন্তানদের জন্য ভাবনার শেষ নেই।
গত মাসে একটা ভাল সমন্ধ এসেছে রানুর। ছেলে নিউ জার্সিতে একটা কলেজ এ শিক্ষকতা করে। এক মায়ের এক ছেলে। কিন্তু রানু কে রাজি করাবে কে? বড্ড জেদী মেয়েটা। তার উপর বাপ তো আছেনই সোহাগ দিয়ে মেয়েকে আরো মাথায় তুলতে!
বীথি তার পরিবার নিয়ে বাহিরে শপিং এ বেরিয়েছে। প্রীতিও সাথে গেছে। রায়হান সাহেব বসে আছেন তার প্রিয় ইজি চেয়ারটায় দুইদিন পুরানো খবরের কাগজ হাতে নিয়ে। সময় পেলেই তিনি পুড়ান খবর ঘাটেন। কেন ঘাটেন, তার রহস্য আজো খুজে পাননি রাহেলা খাতুন। ভাত বাড়া পুড়নো চালের সাথে পুড়ানো খবরের কি সম্পর্ক সে রহস্য উন্মোচন করতে করতে ২৭ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি একই বিছানায়। রহস্য আজও উন্মোচন হয়নি।
রানু অন্ধকার ঘরে শুয়ে রবীন্দ্র সংগীত শুনছে। রাহেলা খাতুন ঘরে ঢুকে বাতিটা জালিয়ে দিলেন।বললেন,
– কিরে মা! অবেলায় শুয়ে আছিস যে! বলেই তিনি মেয়ের বিছানায় বসলেন
– এমনি মা। রানু মা এর কোমর জড়িয়ে ধরলো।
–একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম রে মা। রাহেলা খাতুন ইতস্তত ভাবে রানুর মুখের দিকে তাকালেন।
– হুম বলে ফেলো। তখনো রানু মা এর কোমর জড়িয়ে আছে।
– বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস? সমন্ধটা হাত ছাড়া হয়ে গেলে…!
রাহেলা খাতুন আর এগুলেন না। এখানেই থেমে গেলেন। ততক্ষনে রানু উঠে বসেছে।
– মা! আমি তো বিয়ে করবোনা। জানো তুমি। তবে কেন একি কথা নিয়ে আবারো……… !
কথাটা শেষ না করেই থেমে গেলো রানু।
– এটা কি হয় রে রানু?
– হয়। খুব হয়। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা। আমি আর প্রীতি দুই বোন এক সাথে থাকবো সারা জীবন।
– একদিন আমরা থাকবোনা রে মা। মেয়েদের একটা ঘরের প্রয়োজন হয়। একা থাকা যায় না। অসহায় চোখে রাহেলা খাতুন তাকালেন মেয়ের দিকে।
– কেন? একা কেন? আমি আর প্রীতি। দুই বোন আছি নাহ! আমি চলে গেলে প্রীতির কি হবে? একদিন তোমরা থাকবেনা। সেদিন আমি আর প্রীতি দুই বোন মিলে এক সাথে ঘুরে বেরাবো। সন্ধার মুখে আমাদের বারান্দায় বসে চা খাবো আর তোমাদের ছবি দেখব এ্যালবাম মেলে।
– দুই দুইটা উপযুক্ত মেয়েকে এভাবে রেখে যাবো? রাহেলা খাতুনের মুখে অসহায়ত্ব এবার স্পষ্ট।
– হুম রেখে যাবা। বলেই রানু আবার রবীন্দ্র সংগীতটা ছেড়ে দিলো।
রাহেলা খাতুন এবার আর কথা বাড়ালেন না। উঠে দাড়ালেন। তিনি জানেন মেয়ে তার বড্ড একরোখা। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
*
সময় প্রবাহমান। নিজের গতিতে চলতেই থাকে। মানুষ ও সেই সময়ের সাথে ভেসে যায় এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে। পিছনে ফেলে যায় কিছু সুখ, দুঃখ বিজরিত মুহুর্ত। প্রতিদিন আমাদের এই বেঁচে থাকার লড়াই প্রকৃতির সাথে, সমাজের সাথে, পাওয়া না পাওয়া আর মিথ্যা ও সমঝোতার সাথে।
জীবনের বাস্তবতা বড় কঠিন। মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী চলেনা। একেক সময় একেক দিকে এঁকে বেঁকে চলে। নদীর স্রোতকে যেমন নিয়ন্ত্রন করা যায়না, জীবনের গতিকেও নিয়ন্ত্রন করা যায়না। আমরা অনেক সময় নিজের জন্যই কেবল বেঁচে থাকি। কিছুটা স্বার্থপর এর মত। আমরা কি চেয়েছি, কি পেয়েছি… সেটাই যেন মুখ্য বিষয়। কখনো কখনো আমরা পৃথিবীর সমস্ত শক্তি দিয়েও মনের অবাধ বিচরণকে স্থির করতে পারিনা। অনেক অসম্ভব চলাচলকেও পৃথিবীর মানুষ স্থির করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু পারেনি কল্পনার সাগরে মানুষের মনের অবাধ বিচরণকে স্থির করতে।
মায়া ভয়ংকর এক পিছুটান। এক অসীম দায়ীত্ব। এই ক্ষুদাতুর দুনিয়ায় এক পাল শকুনের মুখে প্রীতিকে একা ছড়ে দেয় কি করে রানু! এখানে প্রতি মুহুর্তে মানুষ একে অন্যকে ছিড়ে খায়। এখানে পথে পথে অসহায়ত্ব কাঁদে। রাতের আঁধারে অমানুষ গুলো কেমন দিশেহারা পায়ে হেটে বেড়ায়। স্ব-জাতীয় দেহ পেলেই ছিন্ন ভিন্ন করে খুবলে খায়।
প্রীতিলতা….. এদের জিবে লালা জড়ানোর মতই এক সুস্বাদু খাদ্য বটে।
মানুষের কিছু কিছু কথা থাকে, কিছু আবেগমাখা দুঃখ থাকে। যা কখনো অন্যকে জানায় না ।পারলে আড়াল থেকেও সেইসব দুঃখকে আড়াল করে রাখে। এই কঠোর কষ্ট গোপনের পন্থা তার ব্যাক্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে হয়তো কিন্তু তার ভেতরটা ধীরে ধীরে মরে যায়। এই স্বল্প পরিসরে কত কি যে দেখেছে রানু! কত জোড়া চোখ যে তাক হয়ে আছে এই বধীর বোনটির দিকে। মাঝে মাঝে প্রচন্ড ভয়ে রানু কুঁকড়ে যায়। মনে হয় কোথায় যে যায়! কোথায় যে লুকিয়ে রাখে প্রীতিকে!
পর্ব-৪
বর্ষা পেরিয়ে শরতের শুরু। প্রকৃতি অনেকটাই শান্ত শীতল। চারিদিকে সবুজের সমারোহ, মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে! ভোরের শিশির ভেজা ধান, শিউলী ফুল, কোমল রোদে পুকুরে ভাসমান শুভ্র শাপলার হাসি সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন এক নতুন রুপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে আজ।
রায়হান সাহেব এর ডাকাডাকিতে রানু ঘুম ঘুম চেখে উঠে এলো। চোখ কচলে বাবার দিকে তাকাতেই দেখলো বীথি এই সাত সকালে চা এর মগ হাতে বাবার চুল টেনে দিচ্ছে। রায়হান সাহেব পরম সুখে চোখ বুঝে আছেন।
রানুকে দেখেই বীথি বললো,
– ঝটপট মুখ ধুয়ে আয়। আমরা তিনজনে মিলে হাঁটতে বের হবো। বলেই আবার বাবার চুল টানায় ব্যাস্ত হয়ে পরলো বীথি।
রানু ঘুম চোখে মাথা ঝাকিয়ে আবার ঘরে চলে গেলো।
পূব আকাশে সুর্য্য তখনো উঁকি দেইনি । অন্ধকার কেটে যাওয়ায় চারিদিকে একটা শান্ত আলোকিত ভাব। আহ ! কি চমৎকার সকাল..ভাবলো রানু।
বাড়ী থেকে নদী বেশীদূর নয়। ১০০ গজ হবে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা তিনজনই নদীর পার চলে এলো। স্বচ্ছ টলমলে জলে নদী কানায় কানায় পূর্ণ। হালকা শীতল বাতাস বইছে। সবে এখন পূর্ব দিগন্তে হলুদ লাল সংমিশ্রনে সূর্য্যি উদয়ান্ত হচ্ছে।
জীবনের যান্ত্রীকতা থেকে কিছুটা দূর, প্রকৃতির এই প্রসন্নতায় মানুষের মন কখনো কখনো উদাসী হয়ে উঠে। রায়হান সাহেবের মুখে সেই উদাসীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
রানু ঠিকই হুঝতে পারে অসহায় পিতার এই উদাসীনতা।
*
বীথি আর রানু জমির মিয়ার কেরামতি চা এর টংগে বসে আছে অধীর আগ্রহে। চোখে মুখে ভয়াবহ উত্তেজনা। জমির মিয়ার ৮ বছরের নাতি মজনু বিলাতী শিশ দিয়ে দিয়ে টুংটাং শব্দে মনের আনন্দে চা বানাচ্ছে। মজনুর নামের শেষে বিলাতী লেজ লাগানোর একটা বিশেষ কারণ আছে। মজনুর জন্মের সময় তার বাবা মালেয়সিয়ায় থাকতেন। সন্তানকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু সন্তানের নামের শেষে বিলাতী লেজ জুড়ে দিতে পেরে মহা আনন্দিত হয়েছিলেন। তবে সেই লেজ বিশিষ্ট ছেলেকে তিনি দেখে যেতে পাবেননি। মজনুর জন্মের ৬ মাস পরই তিনি রোড এক্সিডেন্ট এ মারা যান। সেই থেকেই মজনু বিলাতী তার নানার কাছে আছে।
জমির মিয়া তার বিকট দাঁত বের করে তাকিয়ে আছেন বীথি ও রানুর দিকে । রুপবতী দুইটা মেয়ে তার ধুলি পরা নড়বড়ে টুলে বসে ময়লা কাপে চা খাবে- এই বিস্ময়ে জমির মিয়ার মুখ বন্ধ হচ্ছেনা!
মজনু বিলাতীর চা বানানো শেষ।
– আপা চা রেডি! ফোঁকলা দাঁত বের করে মজনু চা এর কাপ বাড়িয়ে দিল।
চা হাতে নিয়ে কাপে চুমুক দিতেই বীথির কপাল কুঁচকে গেল। বলল,
–কি রে মজনু! এত মজার চা বানানো তোকে কে শিখিয়েছে?
– সবই আল্লাহর ইচ্ছা আপা। এবার মজনু বিলাতীর বাকি দাঁত গুলোও চকচক করে উঠলো।
–হুম। বললো বীথি।
–তুই পরাশুনা করিস না? বীথির প্রশ্ন।
– না আপা।
–কেন? নানাকে সাহায্য করেও তো তুই স্কুলে যেতে পারিস।
– সবি আল্লাহর ইচ্ছা আপা। কপালে নাই পড়ালেখা। চা বেঁইচা পেটই চলেনা। পড়াশুনা করমু কেমনে!
এবার মজনুর চোখে কিছুটা অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো।
– তুই স্কুলে ভর্তি হবি কাল। আমি তোর পড়াশোনা করাবো।
বলেই বীথি উঠে দাড়ালো। মজনু বিলাতীর মুখ হা হয়ে গেল।বিস্ময় কাটছে না! মজনু বলল,
– আপনি কেন আমারে পড়ালেখা করাইবেন আপা?
– সবি আল্লাহর ইচ্ছা রে মজনু! বলেই বীথি টংয়ের বাহিরে পা বাড়ালো।
রায়হান সাহেব ও রানু এতক্ষন ধরে চা পান করার সাথে সাথে বীথি ও মজনু বিলাতীর বাক্যালীপ শুনছিল।বীথিকে উঠতে দেখে এবার তারাও টংয়ের বাহিরে পা বাড়াল।
দুই পাশে সুন্দরী দুই কন্যার হাত ধরে রায়হান সাহেব বাড়ীর পথে পা বাড়ালেন। যেতে যেতে বীথি ভাবলো, গরীব হয়ে জন্মানো আল্লাহর ইচ্ছা কিন্তু জন্মে জীবনভর গরীব থাকাও কি আল্লাহ্ এর ইচ্ছা? মজনুর মত ছোট একটা শিশু যার হাতে থাকার কথা বই কলম খাতা, সে কেনায়ের কাপে খুঁজে বেড়াবে বেঁচে থাকার উপকরণ?
মজনু স্কুলে যাবে। একদিন মস্ত বড় অফিসার হবে, কোট টাই পরে অফিস যাবে। একদিন তার সংসার হবে, বউ হবে, সন্তান হবে। কোন এক শীতের রাতে বউ সন্তান নিয়ে মুভি থিয়েটারে বসে পপকর্ন খাবে। আলো আঁধারীর বন্ধ কামরায় দুষ্টুমির ছলে বউ এর কাঁদে মজনু বিলাতীর আংগুল ছুঁয়ে যাবে!
সময়ের সাথে বদলে যায় দিন, একদিন বদলে যাবে মজনু বিলাতির জীবনও।
*
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। স্বচ্ছ নীলাকাশে সাদা তুলার মত মেঘেদের সাথে সূর্য্যিমামার লুকোচুরি খেলা চলছে। মৃদু শীতল হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আকাশের সঙ্গে মেঘেদের লুকোচুরি দেখে রায়হান সাহেবের মনে পড়ে যায় শৈশব ও কৈশোর কাটানো এমনি কত স্মৃতির কথা! মেঘবালিকাদের সাথে মিতালী করে উড়ে যাওয়া সাদা বকেদের মত, উড়ে যেতে মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে আজ রায়হান সাহেবের।
যত অস্থিরতা আজ তার মনের আকাশে তা কেবল প্রীতিলতার জন্যই । ক্ষনে ক্ষনে মনের আকাশ বেদনায় ঢেকে যায় এক অনিশ্চয়তায়! ভাদ্র মাসের আকাশের মতই গুম হয়ে থাকে রায়হান সাহেবের মনের কষ্ট, তবু কান্না হয়ে কাউকে ভিজিয়ে দেয়না।
এমনি নানান ভাবনায় যখন রায়হান সাহেব বিচলিত, তখনি ঘারের কাছে তিনি কারো উপস্থিতি টের পেলেন। বিমর্ষ রায়হান সাহেব ঘোর কাটিয়ে ফিরে তাকাতেই চমকে উঠলেন! কিছু বুঝার আগেই প্রীতিলতা বাবার কোলে ঢলে পড়ল।
পর্ব-৫
গতকাল থেকে প্রীতির শরীর খুব খারাপ যাচ্ছে। চোখ মুখ শুকিয়ে গর্তে ঢুকে গেছে। মেয়েটা কিছুই মুখে দিচ্ছেনা। বেশ কয়েকবার বমিও হয়ে গেলো। ডাক্তার কাকা এসেছিলেন কাল রাতে। হার্টবিট, ব্লাড প্রেসার আর পালসরেইট দেখে রায়হান সাহেবকে বলে গেলেন সময় করে আজ বিকেল নাগাদ একবার যেন তার চেম্বারে আসেন।
দেখতে দেখতে প্রায় আড়াই মাস হয়ে গেলো। বীথিদের যাওয়ার সময় ও চলে এলো। মেয়ের চলে যাওয়ার কথা মনে এলেই মন ভীষণ ভার হয়ে যায় রাহেলা খাতুনের। এটাই নিয়ম। মেয়ের সংসার ফেলে তো আর সারাজীবন এখানে ধরে রাখা যায়না। তাছাড়া বাচ্চাদের ও স্কুল আছে। সুরেলা প্রি-কে আর ছোটন কিন্টারগার্ডেন এ পড়ে। এমনিতেই ওদের পড়াশোনা ও স্কুলের ক্ষতি হচ্ছে দেশে এসে।
রাহেলা খাতুন মেয়ের জন্য কিছু নকশী কাঁথা করেছেন। প্রীতি নিজ হাতে একটা করেছে বীথিকে দিবে বলে। রান্নার সব ধরনের মশলার প্যাকেট করে রেখেছেন রাহেলা খাতুন। কয়েক ধরনের শুটকি ও প্যাকেট করেছেন মেয়ে জামাইয়ের জন্য।ওখানে সব কিছুর খুব দাম। বীথি বলেছে খাটি সরিষার তেল দিতে দুই বোতল। রায়হান সাহেব মেয়ের জন্য সরিষা ভাঙিয়ে তেল করে রেখেছেন।
আজকের সকালটা খুব ফুরফুরা। সকাল থেকেই ঝকঝকা রোদ দেখা যাচ্ছে। আকাশ পরিস্কার । নীলে আর সাদায় মিলে ভীষণ রকমের এক সচ্ছতা। রাহেলা বেগম খুব যত্ন করে আজ সকালের নাস্তা বানিয়েছেন। ঘি ভাঁজা পরোটা, সাথে মিশ্র সবজি ভাজি আর পায়েস। ছোটন আর সুরেলাও ততদিনে বাঙ্গালী নাস্তা খাওয়া শিখে গেছে।
সবাই খেতে বসেছে এক টেবিলে। রাহেলা খাতুন খুব যত্ন করে সবার প্লেটে নাস্তা তুলে দিচ্ছেন।
মায়ের হাতের পায়েস করা বীথির খুব পছন্দ। বীথি পায়েস মুখে দিতে দিতে বললো,
– মা! তুমি যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাধুনী, এটা কি জানো?
রাহেলা বেগম অবাক চোকে তাকালেন মেয়ের দিকে। মনে হল যেন মেয়ে তাকে হ্যালোয়েলস গ্রিন মাম্বার সাথে সেল্ফি তুলতে বলছে। বীথি বলল,
–হ্যা মা। তুমি খুব ভাল রাঁধো। বিদেশে থাকাকালীন তোমার হাতের রান্না খুব মিস করি।
রাহেলা বেগমের চোখে পানী চলে এলো। মেয়েরা ভালবাসার কথা বললেও তিনি কাঁদেন, মেয়েরা ধমক দিলেও তিনি কাঁদেন। অনেকটা হাতি পশুর মত। হাতি যদিও কাঁদে কিন্তু সেটা কি শুধুই মানব শিশুদের মত অবুঝ কান্না নাকি আবেগের কান্না তা নিয়ে যেমন অনিশ্চয়তা আছেন পশু বিশেষজ্ঞরা, তেমনি রাহেলা খাতুনের কান্না নিয়েও বিভ্রান্তিতে থাকেন তার মেয়েরা।
*
সেই কখন থেকে রায়হান সাহেব আর রানু বসে আছে ডাক্তার বাবুর চেম্বারে। এক ঘন্টা হলো প্রায়। প্রীতি নখ খুঁটে খুঁটে দূর্বল চোখে এদিক ওদিক দেখছে।
রায়হান সাহেবের হাতে দুটি পানির বোতল। একটি বোতল তিনি প্রীতির দিকে এগিয়ে দিলেন।
– পানি খাবি রে মা?
প্রীতি মাথা নেড়ে না জানালো।
– তুই খাবি রানু?
রানু হাত বাড়িয়ে পানির বোতলটি নিলো। ঢগঢগ করে প্রায় আধা বোতল শেষ করে ফেললো।
রানুর অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। কিসের অস্থিরতা ঠিক বুজতে পারছে না। মনে হচ্ছে শৈত্য প্রবাহে কোথাও কিছু একটা জমে যাচ্ছে। আবার প্রচন্ড তাপে সেই জমে যাওয়া কিছু গলে গলে পরছে।
পর্দা সরিয়ে ডাক্তার বাবুর এসিস্ট্যান্ট রায়হান সাহেবের দিকে হাত নেড়ে ভিতরে যেতে বললেন । রায়হান সাহেব ভয়ার্ত মুখে ভিতরে ঢুকলেন। পিছু পিছু রানু। রানুর অস্থিরতা আরেক ধাপ বেড়ে গেলো! কুকুরের মত নাকের ডগায় একটা দুর্গন্ধ টের পেলো। ডাক্তার বাবুলখুব সরল ভাবে বললেন,
– যা ভেবেছিলাম তাই
– কি ভেবেছিলেন? রায়হান সাহেব উদ্ধিগ্নতা বেড়ে গেল। রানু কান সোজা করে শুনছে ডাক্তার বাবুর কথা। বুক ধুকধুক করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি প্রচন্ড তাপে কিছু একটা গলতে শুরু করেছে। রানুর সমস্ত শরীর ঝাঁকানি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সামনের ডাক্তার বাবু, চেয়ার টেবিল, স্টেথিস্কোপ, পানীর বেতল…. সব থেতলে যাচ্ছে।
*
সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় জীবন।বদলে যায় জীবনের রথ। সেই সাথে সুকৌশলে বদলে যায় সারথী, বদলে যায় আরোহী। শুধু বদলায় না মস্তিষ্কের কোন এক গোপন কুঠুরীতে ঘাপ্টি মেরে থাকা বহু পুরাতন স্মৃতি। হাজার চেষ্টায় ও সে স্মৃতিকে অস্বীকার করা যায়না। সরানো যায়না। তেমনি একটা স্মৃতি আজ বার বার রানুর মনকে অস্থির করে তুলছে। তখন রানু ক্লাস সেভেন এ পড়ে। গ্রাম থেকে ছোট মামা এসেছেন তার দলবল নিয়ে শহরে ডাক্তার দেখাবেন বলে। সব মিলিয়ে উনারা সাত জন । রাতে এক রুমে গাদাগাদি করে সবাইকে ঘুমানোর ব্যাবস্থা করেছেন রাহেলা খাতুন। শীতের রাত। পর্যাপ্ত লেপ বা কম্বল না থাকায় সবায় ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন । রানু সবার ছোট বলে তার কম্বলটিও দিয়ে দেওয়া হলো ছোট মামার পরিবারকে। সেই রাতের জন্য রানুকে বলা হলো প্রীতির সাথে কম্বল ভাগ করে ঘুমাতে। যথাবীতি রানু গেলো প্রীতির সাথে একি কম্বল ভাগ করে ঘুমুতে। সেই রাতে একটু বেশীই যেন শীত বেড়ে গেলো। হঠাৎ প্রীতি লক্ষ্য করলো রানু ঠঁক ঠঁক করে কাঁপছে। কপালে হাত রেখে প্রীতি ভীষণ চমকে গেলো। একি! গা তো পুড়ে যাচ্ছে রানুর! এত রাতে মা’কে আর না ডেকে নিজেই কাপর ভিজিয়ে বাটিতে করে নিয়ে এলো। গায়ের কম্বলটি দু’ভাজ করে রানুর গায়ে পেঁচিয়ে দিয়ে রাতভর ছোট বোনের কপালে ভেঁজা কাপর দিয়ে মুছে দিতে লাগলো। রানু শুধু শক্ত হাতে প্রীতিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।
কত কথা আজ স্মৃতির ক্যানভাসে যে ভেসে উঠছে রানুর! চোখের কোনে মুক্তদানা গুলো ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে দু’গাল বেয়ে। কেন এমন হয়? মানুষের জীবন আসলেই নদীর মতো। নদীর বাঁক পরিবর্তনের মতোই মানুষের জীবন বারবার নতুন দিকে মোড় নেয়। নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে মানুষের জীবন।জীবনের অনেক কিছুই হঠাৎ বদলে যায় কোন আগাম সংকেত ছাড়াই। কেন বদলে যায়? জানতে চেয়েও জানা হয়নি জীবনের এই কঠিন রহস্য।
চোখের পানীগুলো মুছে নিয়ে রানু এগিয়ে গেলো প্রীতির ঘরের দিকে। প্রীতি শুয়ে আছে এক কাত হয়ে। ভীষণ দূর্বল আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে প্রীতিকে।
– আপু। রানু ডাকলো।
ঘুরে মুখ ক্লান্তিতে ফিরে তাকাল প্রীতি।
– তোর সাথে কিছু কথা আছে। বলেই ঘরের দরজাটি হুট করে বন্ধ করে দিলো রানু।
পর্ব-৬
আজ মেঘদূত নিয়েছে আড়ি। সেই সকাল থেকে ক্রমাগত বৃষ্টি হচ্ছে। থামার কোন নাম নেই। বৃষ্টির সাথে প্রেম-বিরহ ও মন খারাপের কেমন যেন একটা অনড় সম্বন্ধ রয়েছে। বৃষ্টি চিরকালই আমাদের হ্নদয়ে আছড়ে দেয় এক পশলা স্মৃতি। বিশুদ্ধ বৃষ্টি জলে ভিজে যে মেয়েটি হেসে কুটি কুটি হয়, সে আজ জলের আত্মচিৎকারে জ্বলে যেতে চায়। শুভদা একদিন বলেছিল, রানু! আকাশ কেন কাঁদে জানো?? রানু বলেছিল, না। শুভদা তখন বলেছিল, শোন রানুনি। মাটির বুকে মিশে যেতে আকাশ কাঁদে। আমিও কাঁদি আকাশের মত, ঠিক তোমার মাঝে মিশে যেতে।
রানু সেদিন কিছু বলেনি। শুধু সূর্যাস্ত দিগন্তে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, শুভদা! সন্ধ্যা হয়ে এল। আমি যাই।
তারপর প্রায় মাস গেল। শুভদা আর এলো না। অভিমান, না অনুযোগ ঠিক বুঝে উঠেনি রানু। তারপর হঠাৎ একদিন জানতে পেল, শুভদা উচ্চশিক্ষায় দেশের বাহিরে চলে গেছে। কি যে ভীষণ ক্ষরতাপে জমিন ফেঁটে সেদিন আগ্নেয়উত্তাপ আকাশ বাতাস সব দূষণ করে দিচ্ছিল! মনে হচ্ছিল সে উত্তাপে পৃথিবী পুড়ে যাচ্ছিল।
তারপর নীল খাম হাতে বন্ধ ঘরে খাতা টেনে বসেছিল রানু। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে লিখেছিল,
শুভদা,
তুমি তো অনেক কিছু জানো। বলতো বুকের কোন পাশটায় কষ্ট জমে থাকে? ডানে না বামে? আমার আজ দু’পাশেই খুব ব্যথা।
শুভদা, তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, ভরা পূর্নিমায় তোমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখব। লিখবো লিখবো করে কত রজনী গিয়েছে কেটে বর্ণমালায় সুঁই সুতো গুঁজে শব্দের মালা আর গাঁথা হয়নি। ফাগুনে ফাগুনে কতবার গাছের পাতা গিয়েছে ঝড়ে, কত বসন্তে কদমের ঘ্রাণে ধরনী উঠেছে কেঁপে! ভরা পূর্নিমায় অলৌকিক ইন্দু প্রভায় মানব সভ্যতা কতবার মেতেছে উল্লাসে তবু, তোমাকে একটা কবিতা লিখা হয়নি।
শুভদা, মুক্তস্বরে আমার আর্তনাদ শুনতে কি পাও?
আকাশের বুক ফুঁড়ে দেখো আজ কেমন শোকগাঁথা। বুকের ভীতর বিঁষ ঢুকেছে শুভদা। সে বিঁষে কেবল আমার দখল, এখানে তোমাকে মানায়না। জানো তো, কষ্টের দামে আমাকে চাওয়া ঘোর অপরাধ, অপরাধ। তোমাকে না পাওয়ার আকাঙ্খায় মহাকালের ঘূর্ণায়নে মনের ভিতর হু হু করে বাতাস ঢুকে। তোমার বুকে জমাট বাঁধা অভিমান উষ্ণ আলিঙ্গনে আমায় শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়। শুভদা, বলো তো, বৃষ্টিজলে ভেসে আসা ভ্রমরা মাতাল কদমের ঘ্রাণে কেন মরে? বল, বল! বল শুভদা, সকাল দুপুর বিকেন সন্ধ্যা… আমার কেন সব রাত হয়ে যায়?
শুভদা, কিছু আঁধারের কথা বলি তবে শোন! আঁধারের নগ্নতায় বিষাদের ছাপের কথা শুনেছো কখনো? কিংবা কফিনে বন্ধি উড়ে যাওয়া চিলের নৈঃশব্দিক পদচারণার কথা? শোন তবে বলি, নর্দমায় পড়ে থাকা যারজ হ্নদপিন্ডটুকু তোমার আকাশে ঘুড়ি উরাবে না। কখনোই না। বুক বেয়ে হামাগুড়ি দেয়া আমার নির্বিকার জীবন, তোমার খোঁজে কখনো আর চোখের জলে বুক ভাসাবেনা।
শুধু জেনে রেখো, কাল্পনিক স্বপ্নে আশা জাগানিয়া প্রেম, আমার জন্য নয়।
তুমি খুব ভাল থেকো শুভদা।
ইতি
রানু
সেই চিঠি নীল খামে আজও মুখ বধীর হয়ে পড়ে আছে। শুভদাকে আর দেয়া হয়নি।
*
স্মৃতির ক্যানভাসে আজ কত কি মনে পরছে রানুর। আজ তার মন খারাপের দিন। সেই সকাল থেকে রানু দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে।সারাদিন কিছু খায়নি। রায়হান সাহেব বেশ কয়েকবার দরজায় কড়া নেড়ে গেলেন।রানু সারা দেয়নি। এবার রাহেলা খাতুন দরজায় টোকা দিতেই রানু বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। এবার দরজা খুলতে হবে। নয়তো ঘোর বিপদ। না খেয়ে মেয়ে দরজা বন্ধ করে আছে এই আতঙ্কে তিনি পীর-কবিরাজ, ফু বাবা, ন্যাংটি বাবা… সব বাবাদের পালকিতে করে বাসায় তুলে নিয়ে আসবেন। তারপর শুরু হবে আগরবাতি জ্বালিয়ে ঝারফোক। আর সেই আগরবীতির গন্ধে বমি শুরু হবে রানুর।
–এই রানু! দরজাটা খুল!
রাহেলা খাতুন ডাকছেন। রানু এতক্ষন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মায়ের ডাকে সন্মোহন কেটে গেল রানুর। এবার দরজাটা খুলে দিল। রাহেলা খাতুন উদ্দিগ্ন হয়ে ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই মেয়ের দিকে কেমন বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। রানু বলল,
–মা কিছু বলবে?
রানুর দিকে খুব গভীর ভাবে তাকালেন রাহেলা বেগম। কেমন যেন অসহায়বোধ করতে লাগলেন তিনি। বললেন,
–সারাদিন কিছু খাসনি মা। শরীর খারাপ করবে। তোর যদি কিছু উলটপালট হয়ে যায়….! এমনিতেই কত বিপদ..!
রাহেলা বেগমের চোখ ভিজে উঠলো। চোখের জল লুকাতে তিনি জ্বানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
রানুর মুখে এবার সামান্য বিদ্রুপের হাসি দেখা গেল। বলল,
–মা। না খেয়ে কেউ অসুস্থ্য হয়না, মরেও না। মানুষের যত অসুখ সব মনে। মনের অসুখে মানুষ মরে, শরীর তো কাঁদা-মাটি-জলে তৈরী।
রাহেলা বেগম এবার কাছে এসে মেয়েকে ঝাপটে ধরলেন। বুক ফেঁটে তার সকল বিষাক্ত নিঃশ্বাস যেন চোখের জলে গড়িয়ে পরতে লাগলো। রানুর বুকের মধ্যে কেমন গিঁট লাগতে শুরু করলো। মনে হল ডায়াফ্রাজম কাজ করছেনা। ফুসফুসের অভ্যন্তরিন অতিক্ষুদ্র অ্যালভিওলাস কোষগুলোর গণহারে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে! ফুসফুস খুব দ্রুত সন্চালনে ব্যস্ত। রানু আরো বেশী করে রাহেলা খাতুনকে বুকে চেপে ধরলো।বিক্ষিপ্ত মনে বিরবির করে বলতে লাগলো, মা! রাস্তা থেকে কুঁড়িয়ে এনে যেই অসাড় শিশুটিতে তুমি নিজ বুকে ধরে পরিবার দিয়েছো, সমাজে অবস্থান দিয়েছো, আত্মনির্ভরশীল হতে ভালবাসা ও সাহস দিয়েছো, সেই শিশুটি আজ শিশু নেই, সে আজকের রানু; তোমার রানু। তোমার এই চোখের জলের পরিনাম তাকে ভোগ করতেই হবে মা।
শেষ পর্ব
কাল সারারাত ঘুম হয়নি রানুর। মৃত্যুর স্বাদ নিতে নিতে যেমন মানুষ আঁকরে ধরে পুরণো স্মৃতি, তেমনি কাল রাতভর পিপীলিকার মত হাজার স্মৃতি ঘিরে রেখেছিল রানুকে। দাদীমার কথা, শৈশব-কৈশরে পুতুলের বিয়ে, বউচি, কুতকুত, কানামাছি আরো কত কি খেলা ভেসে উঠছে আজ রানুর মনের দৃশ্যপটে!
মনে পড়ে রানু তখন পাঁচ কি ছয় বছরের শিশু। দাদীমা তখন সুস্থভাবেই বেঁচে ছিলেন। সে সময় শীত এলেই বাড়ীতে তখন চলতো অগ্রহায়ণের নতুন চালের পিঠা উৎসব। প্রায়ই আত্বীয়রা আসতেন। রাহেলা খাতুন খুব মজা করে নানান রকমের পিঠা করে তাদের খাওয়াতেন। অন্যদের খাওয়াতে রাহেলা খাতুন খুব পছন্দ করেন।
এমনই এক শীতের দিনে রায়হান সাহেবের চাচাত ভাই এলেন বাড়ীতে স্ত্রী ও ছোট দুই ছেলে নিয়ে। এক রাত্রি থাকার কথা তাদের। সারাদিন খুব আনন্দ উল্লাসে কাঁটলেও সমস্যা হল রাতে। চারজন বারতি মানুষের শোবার জায়গা হলনা। নিরুপায় রাহেলা খাতুন নিজ কক্ষটি ছেড়ে দিলেন তাদের জন্য। তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি ড্রয়িংরুমে বিছানা পেতে শোয়ার ব্যাস্থা করলেন। রায়হান সাহেব গেলেন তার মায়ের সাথে ছোট ঘরের বিছানায়।
রাত তখন প্রায় কতটা রানুর ঠিক মনে পড়ছেনা তবে সবাই যে তখন গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল, তা রানুর মনে আছে।
সব স্পর্শই কি মমতার নদীতে ভালবাসার ঢেউ তুলে? স্নেহের বাঁধনে সম্পর্ককে পোক্ত করে? না, করেনা! কিছু স্পর্শ কেবল কামনায় সিক্ত হয়। চিরসত্য যা তা অস্বীকার করা সহজ নয়। অহংকারী বীর্যবান পুরুষের পশুত্ব ঘাপ্টি মেরে থাকে দিনের আলোয়। সুযোগ পেলেই নিশিথে মাথা চারা দিয়ে উঠে ভিতরের লুকায়িত পশু। হুংকার ছেড়ে মনুষ্যত্ব হারায় বীর্যবান পুরুষ। ঢেকে দেয় এক সীমাহীন আঁধারে নারীর নারীত্ব। দুর্বার কান্নায় পাথরের চোখে জল এসে যায়, তবু সে জল স্পর্শ করেনা পুরুষের কঠিন হৃদয়। পুরুষ চিরকালই পিপাসার দাস। সেই পিপাসায় বুভুক্ষ পুরুষ ছিন্ন করেছে কত বন্ধন। চটি পায়ে মাড়িয়ে গেছে কত সদ্য ফুটে উঠা লাল- নীল -হলদে সন্ধ্যা মালতীর বাগান। তার দুর্গন্ধময় বীর্য ছড়িয়ে দিয়েছে জমিনে, কাল থেকে মহাকালে। পুঁতে দিয়েছে নারীর সতীত্বকে হাজার গজ জমিনের গহীনে যেখানে উর্ভর মাটি শেষে কেবল অনুর্ভর কীট-পতঙ্গ মাটি আঁকরে বেড়ে উঠে। রানুর ভাব্লেশহীন মুখে কোন ক্রীয়া- প্রতিক্রীয়া নেই আজ। যেন তার অন্তরাত্মা জানে ভবিষ্যৎ! ভাবতে ভাবতে শীতল চোখে রানুর এক ঝলক আনন্দের হাসি খেলে যায় হঠাৎ।
*
রায়হান সাহেব কে ঘুমের ঔষদ দেয়া হয়েছে। প্রেসার অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। রাহেলা বেগম স্বামীর পাশেই বসে আছেন। মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। বীথি তার জিনিস পত্র গোছাতে ব্যাস্ত। আর মাত্র ৩ দিন। বীথি ফিরে যাচ্ছে তার দেশে।
– আসবো আপু? দরজায় দাঁড়িয়ে রানু জিজ্ঞেস করলো।
– আয়। বীথি কাপর গুছাতে গুছাতেই বললো।
– আপু।
– হুম।
– তোকে আমি খুব বেশী রকমের ভালবাসি। রানু বললো।
– জানি রে পাগলী। আমিও তোকে খুব ভালবাসিরে রানু। বলেই বীথি ঘুরে দাড়ালো। দু’হাতে রানুকে জড়িয়ে ধরলো। বীথির চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। রানু দু’হাতে বোনের পিঠ আঁকড়ে ধরে বললো,
– পৃথিবীর নিয়ম খুব বিচিত্র। তুই কি জানিস আপু ভালবাসার মানুষ গুলোকেই আমরা সবচেয়ে বেশী কষ্ট দেই?
রানুর ভিতরের শক্ত জমে যাওয়া কিছু একটা যেন আবারো গলতে শুরু করেছে। অলক্ষে চোখের জল গড়িয়ে পরছে। দু’বোনের ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলে গড়ে উঠছে এক জল ভরা দীঘি। কেউ জানেনা কার ব্যাথা কিসে। একি দীঘিতে কষ্টের নোনাজলে টই টুম্বুর। শুধু সেই জলের স্বাদ ভিন্ন।
রানু এবার শক্ত করে বোনকে চেপে ধরলো। বিরবির করে বলতে লাগল, আমায় ক্ষমা করিস আপু। আমি তোকে খুব ভালবাসি।
*
দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয় নাশক দুর্গা যেন আজ শশরীরে নেমে এলো ধরনীর বুকে। দুর্গম নামক অসুরকে বধ করতে মা দুর্গার হাত কাঁপেনি। মহিষাসুর কে পরাস্ত করে করে পাপমুক্ত হতেও তার হৃদয় কাঁপেনি। কতভাবেই না মহিষাসুর নিজের প্রাণ বাঁচাতে দুর্গার শক্তিকে ব্যহত করতে চেয়েছেন। কখনো মহিষের বেশে, কখনো সিংহ বা হাতীর বেশে। কিন্তু প্রতিবারই দুর্গা তার প্রতিবাদী তলোয়ারের ঝংকারে হয় গলা থেকে মাথা কেটে আলাদা করে দিয়েছেন, নয় সূড় কেটে পরাশক্তির শক্তিকে বধ করেছেন। শুভ শক্তির কাছে অশুভ শক্তির পরাজয় নিশ্চিত।
ভোরের কাঁক তখনো ডাকতে শুরু করেনি। চারিদিকে আলো আঁধারীর এক অস্পষ্ট খেলা। প্রকৃতি আজ ভীষণ শান্ত। মাঝে মাঝে কিছু শুকনো পাতার মরমর ধ্বনি। আর নিন্মসুরে চাপা এক করুন সানাইয়ের ধ্বনি বেজে চলেছে। বাড়ীময় এক নিষ্ঠুর নীরবতা।
রায়হান সাহেব হত বিহব্বল। তার দৃষ্টিতে কোন ভাবের লেশ নেই।পৃথিবীর নিষ্ঠুরতায় তিনি বাকরুদ্ধ। রাহেলা খাতুন জ্ঞান হারিয়ে পরে আছেন বিছানায়। প্রীতিলতা গভীর মমতায় মায়ের মুখে চোখে পানির ছিটা দিচ্ছেন। এই মুহুর্তে মা’কে সারিয়ে তুলাই যেন মুখ্য। বীথি দুই ছেলে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদে যাচ্ছে। বিস্ময়ে বাচ্চারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছেনা। কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই তাদের বোধগম্য নয়।
পাশের ঘরেই রানু তাকিয়ে আছে মন্জুরুল হকের দিকে। কি ভয়াবহ শান্ত দুটি চোখ তার আজ! নিষ্ঠুরতার জলজলে চোখে এক তৃপ্তির আভাস। ঠোঁটের কোনে ঈষৎ হাসি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রক্তে ভেজা বটিটা এবার মাটিতে ছুড়ে ফেললো রানু। পাশেই রক্তে ভেসে যাচ্ছেন মঞ্জুরুল হক।
পাপকে একদিন বাঁচিয়ে রাখা মানে পৃথিবীর একদিনের ক্ষয়। পাপকে চিরতরে তৎক্ষণাৎ নির্মুল করে দিতে হয়!তবেই না ধরনী শান্ত হয়!
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত জীবের দুর্গতি হরণ করার জন্য আবির্ভাব হয়েছিল দেবী দুর্গার। তেমনি শ্রষ্টা নতুন রুপে দুর্গার পুন-আবির্ভাব ঘটালেন রানুকে দিয়ে। রানুর আরেক নাম হয়ে গেলো দুর্গা।
Published by HB Rita on Saturday, January 10th, 2015