ফাতেমা-ইছমা

আমরা যারা সমাজ গড়ি, সমাজের নিয়ম নির্ধারণ করি, তারা কতটা মানবিক আসুক দেখা যাক-

★ঘটনা একঃ

ফাতেমা বেগম, বছরের পর বছর মদ্যপ স্বামীর যৌতুকের জন্য অত্যাচারীত হয়ে, মার-গালি সহ্য করার পর এক পর্যায়ে অতিষ্ট হয়ে দাম্পত্য জীবনের ১৪ বছর পার করার পর প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। স্বামীর ঘর ছেড়ে তিনি তার বিরুদ্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

সুশীল সমাজঃ
-হায় হায় করসে কি! এত বছর সহ্য করতে পারল আর এখন সহ্য হইল না?
-কোন কাহানী আছে এইখানে।
-বেটির মনে হয় আরেক বেটা মনে ধরসে।
-বড় বড় পুলা মাইয়া রাইখা বেটি এইডা কি শুরু করসে!

★ঘটনা দুইঃ

দারিদ্রতার কারণে আজো বিয়ে হয়নী ইছমার। বাবা এক মিলের দাড়োয়ান। মা আলসারের রুগী। ছোট ভাই বাদাইম্মা প্রকৃতির। অভাবের দরুন ও দেখতে তেমন সুশ্রী না হওয়ায়, ৩৫ বছর বয়সেও ইছমা অবিবাহিতা। আজ যদি সে ভালবাসার অভাবে, ক্ষুদ্র মনে স্বপ্নের তাড়নায় কিংবা অভাবের তাড়নায় কারো সাথে সম্পর্ক করে বা অনৈতিক কিছু করে বসে, তাহলে?

সুশীল সমাজঃ
-আহারে! মাইয়াডার বিয়া অইল না।
-অইবো কেমনে! বেলসমাডারে কে বিয়া করবো!
-মালেকের ঝি ডা বুইড়া বাত্তি হইয়া রইসে, বিয়া হয়না!
-এই মাইয়ার চরিত্র ভালা না।

ঘটনা তিনঃ

বানু। গার্মেন্টস কর্মী। এলাকার বখাটে ছেলেদের পাত্তা না দেওয়ায় একদিন সুযোগ বুঝে কিছু ছেলে-পেলে বানুকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পাশের বস্তিতে। রাতভর পালা করে চলে অমানবিক দৈহিক নির্যাতন।ক্ষমতার লড়াইয়ে দূর্বল বলে বিচার পায়নি বানু। এখন সে আবারো পেট চালাতে গার্মেন্টসে কাজ করেন।

সুশীল সমাজঃ
-মাইয়া মানু ঘরে না থাইকা বেডাগোর লগে গা ঘেশাইয়া কামলা দিতে গেলে এমনই হইবো।
– মাইয়ার ও দোষ আছে। ওইদিন দেখছি দাত কেলাইতে কেলাইতে ম্যানাজারের লগে কথা কয়।

-গারেমেন্স মাইয়ালোকের চরিত্রের ঠিক আছে?

এই হল আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনাসমূহ যা সামাজিক বৈরী রোষাণলে প্রশ্ন হয়ে থেকে যায়।
এই যে ফাতেমা বেগম দিনের পর দিন মদ্যপ স্বামীর ভোগের বস্তু হয়েছেন, একফুটা ভালবাসার বদলে সয়েছেন কিল, লাত্থি, ঘুষি… এই যে ফাতেমা বেগমের বাঁচার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল তার প্রভু নামক স্বামী (আমি বলিনা, সমাজ বলে), তখন সমাজ বা তার অন্তরভুক্ত শ্রেণির মানুষগুলো কোথায় ছিল? কখনো কি ফাতেমা বেগমের পিঠে স্বস্থির হাত রেখেছে তারা? মমতার হাতে তার নিশিথের গোপন অশ্রু মুছে দিয়েছে কেউ? তাহলে আজ কেন তার ঘর ছাড়ায় সমাজের এত দুঃচিন্তা?

ইছমার জন্য অল্প বয়সে ভরা যৌবনে কি কখনো ভেবেছিলে কেউ? তার ঘর বেঁধে দিয়েছিল কেউ? তবে আজ এই যে তাকে নিয়ে কটাক্ষ, নিন্দা..এত দ্বায়ভার কেন সমাজের? ইছমাদেরও সুখের প্রয়োজন হয়, শারীরিক ক্ষুধায় ওরাও কখনো কখনো নরপশু পুরুষদের মত ভয়ানক যাতনা অনুভব করেন। ওদেরও  স্বপ্ন সাজাতে ইচ্ছে হয়।সমাজ কখনো কি ভেবেছে তাদের কথা? যদি নাই ভাবে, তবে আজ কেন ইছমারা নষ্ট হওয়া, ভুল পথে যাওয়া তাদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়?

বানুরা কি স্বাধে অন্যের ভোগের বস্তু হতে যায়? ধর্ষণ কার প্রিয়? কারো না। ওরা কুকুরদের লালসার শিকার। তাই বলে ওদের ধরলে ছ্যুত লাগবে না। ওদের বিয়ে করে কেউ পূর্ণ নারীর মর্যাদা দিবে না কারণ ওরা ধর্ষিতা। সিগারেটের গায়ে সিল মারা “সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ” এর মতো ইছমাদের গায়েও সিল মেরে দিবে সমাজ, কেন?

শুনুন মশায়, যদি নাই পারেন অন্যের দুঃখ লাঘব করতে, যদি নাই দিতে পারেন কারো বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা, যদি কারো জীবন সাজাতে উৎসাহবোধ না করেন, তবে দয়াকরে চিত্ত বিনোদনের জন্য সময় ব্যয় না করে নিজ অন্তরাত্মাকে জাগ্রত করুণ। মানুষ হিসাবে আপনি নিশ্চয়ই যথেষ্ট জ্ঞানী। নিশ্চয়ই আপনী বিবেক বর্জিত পশু নন। নিজেদের তুষ্টিতে সমাজ নামক কাঠামো গঠন করে আপনারা আঙ্গুল চালানো ছাড়া তেমন কোন কৃতীত্ব অর্জন করেননি।

————-HB Rita