৭ মার্চ আওয়ামী লীগের জনসভায় নারী-পুরুষের মিছিলে, বাংলামোটর এলাকায় এক কলেজছাত্রীকে যৌন হয়রানি নিয়ে বিগত কয়েকদিন ধরে ফেইসবুকে তোলপাড় চলছিল। উক্ত কলেজ ছাত্রী তার আনিত অভিযোগ ফেসবুকে পোষ্ট করেন। সেখান থেকেই খবরটি ভাইরাল হয়। শুধু ওই কলেজছাত্রী নয়, আরো কয়েকজন আওয়ামী লীগের জনসভার লাঞ্ছনা ও যৌন হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ করেন।
শান্তিনগর মোড়ে ঘটে যাওয়া যে ফেইসবুক স্ট্যাটাসটি বেশী ভাইরাল হয়, সেই স্ট্যাটাসটিতে ঢাকার এক কলেজছাত্রী লিখেছেন,
“শান্তিনগর মোড়ে একঘণ্টা দাড়ায় থেকেও কোন বাস পাইলাম না। হেটে গেলাম বাংলামটর। বাংলামটর যাইতেই মিছিলের হাতে পড়লাম। প্রায় ১৫-২০জন আমাকে ঘিরে দাড়াইলো। ব্যস! যা হওয়ার থাকে তাই। কলেজ ড্রেস পড়া একটা মেয়েকে হ্যারাস করতেসে এটা কেউ কেউ ভিডিও করার চেষ্টা করতেছে। আমার কলেজ ড্রেসের বোতাম ছিঁড়ে গেছে, ওড়নার জায়গাটা খুলে ঝুলতেছে। ওরা আমাকে থাপড়াইসে। আমার শরীরে হাত দিসে। আমার দুইটা হাত এতগুলা হাত থেকে নিজের শরীরটাকে বাঁচাইতে পারে নাই।”
অপর একজন লিখেছেন,
“হল থেকে বের হয়ে কোন রিক্সা পাইনি। কেউ শাহবাগ যাবে না। হেটে শহীদ মিনার পর্যন্ত আসতে হয়েছে। আর পুরোটা রাস্তা জুড়ে ৭ মার্চ পালন করা দেশভক্ত সোনার ছেলেরা একা মেয়ে পেয়ে ইচ্ছেমতো টিজ করছে। নোংরা কথা থেকে শুরু করে যেভাবে পারছে টিজ করছে।”
ভুক্তভোগী আরেকজনের স্ট্যাটাস ছিল,
“’আজ যে আমি স্বাভাবিক অবস্থায় বাসায় ফিরতে পারবো জানতাম না। এতগুলো হায়েনার চোখ উপেক্ষা করে সাইন্স ল্যাব থেকে কাকরাইল এর জার্নি আমার জন্য কম কষ্টের ছিলো না তাও পুরো পথ হেটে, তবে কিছু কিছু হায়েনার চোখের ভাসা দেখে কেঁদে দিবোই ভাবছিলাম।”
সাতই মার্চের জনসভা ঘিরে যৌন হয়রানির অভিযোগ মিথ্যে ছিলনা। ভিডিও ফুটেজে ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের জনসভায় নারী লাঞ্ছনা ও যৌন হয়রানির সত্যতা মিলেছে বলে রোববার দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁও আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ ব্যাপারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গত বৃহস্পতিবার একটি মামলাও হয়েছে।
ফেইসবুক ঘুরে বিগত কয়েকদিনে ৭ই মার্চে ঘটে যাওয়া নারী লাঞ্চনা নিয়ে বেশ কিছু স্ট্যাটাস চোখে পড়লো। কেউ লিখেছেন, “এগুলো ফেইক আইডি। সবার নজর কাড়তে মেয়েগুলি শো-আপ করছে।” কেউ লিখেছেন, “ফেসবুকে মেয়েগুলি পরিবেশ নষ্ট করে দিল।” কেউ লিখেছেন, “এগুলি বিরুধী দলের উস্কানী। মেয়েগুলি টাকা খেয়েছে।”
কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে ফেসবুকে নিন্দার ঝড় তুলেছে যে স্ট্যাটাসটি তা ছিল ৮ই মার্চে দেয়া অস্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সেক্রেটারী নুরুল আজিম রনির একটি কুরুচীপূর্ণ স্ট্যাটাস।
একজন আওয়ামী ভক্ত ছাত্রলীগ নেতা যিনি নিজ ওয়ালে ‘About’ এ লিখেছেন,”তুমি বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসো, আমি তোমাকে ভালবাসবো”, বলা বাহুল্য তিনি একজন খাঁটি আওয়ামালীগ ভক্ত। তাতে কোন সমস্যা দেখছিনা। আমার প্রিয় নেতাকে বা দলকে আমি ভালবাসতেই পারি। তবে সে ভালবাসায় যদি বিবেক ও চোখ অন্ধ হয়ে যায়, তবে সমালোচনায় পড়তেই হবে। তিনি নিজ স্ট্যাটাসে লিখেছেন,
“বাজারে প্রচুর দেহ ব্যবসায়ী পাওয়া যায় যাদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য আদালতে নারী নির্যাতন মামলা করে থাকেন এই সমাজের এক শ্রেনীর মানুষ।
আদালত সংশ্লিষ্ট আইনজীবিরা এমন অনেক কেইস প্রতিদিন পরিচালনাও করেন।তাদের কাছ থেকে এমন ঘটনাগুলো জেনে নেবেন।
প্রধানমন্ত্রীর পোগ্রামে যারা নারীদের গনহারে যৌনহয়রানী হয়েছে দাবী করে ফেসবুকে কান্না করছেন তাদের পরিবারের মা মেয়ে বউ শালীদের নির্ঘাত ঐ আদালত পাড়ার দেহব্যবসায়ীদের মতো ভাড়ায় খাটানো মামলার বাদী বানানো যাবে।এটা আমার বিশ্বাস।
যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছে দাবী করা ৪ জন নারীর(আসল নাকি নকল আইডি তা জানিনা) স্ট্যাটাস দেখুন।তাদের কথায় বুঝা যাচ্ছে,তারা ৭ই মার্চ দিনটিকে নিয়ে মহা টেনশনে আছেন।যৌন নিপিড়িত কোন নারীর পক্ষে এমন উচ্ছাস প্রকাশ করে অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যদি খালেদা ভক্ত বিএনপির সাবেক নারী সাংসদ শাম্মী আক্তারদের মতো আত্মস্বীকৃত ….নারী হয়ে থাকেন তবে তা অন্য বিষয়।”
তিনি দাবী করেছেন, ৭ই মার্চের সমাবেশে যারা যৌন হয়রানী হয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন, তাদের পরিবারের মা-মেয়ে-বউ-শালীদের আদালত পাড়ায় দেহব্যবসায়ীদের মত ভাড়ায় খাটানো মামলার বাদী বানানো যাবে। তিনি আরো বলেছেন, বাজারে এমন বহু দেহব্যবসায়ী পাওয়া যায় যাদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আদালদে নারী নির্যাতন মামলা করে থাকেন এক শ্রেণির মানুষ।
নুরুল আজিম রনির বক্তব্যে স্পষ্ট যে, তিনি উক্ত অভিযোগকারীদের দেহ ব্যবসায়ী ভাবছেন এবং আনিত অভিযোগগুলো শুধুমাত্র তার প্রিয় দলকে বদনাম করতেই বিরুধী দলের কারসাজি।
আমি জনাব নুরুল আজম রনির কাছে জানতে চাই, আপনার কাছে নারী মানেই কি টাকার বিনিময়ে পাওয়া দেহ? নারীকে এতটা ঘৃণ্য দৃষ্টিতে বিচার করার শিক্ষা কি আপনি পরিবার হতে পেয়েছেন? নাকি এটা কেবল আপনার বিকৃত মানসিকতার বহিপ্রকাশ? আরো একটি প্রশ্ন রাখতে চাই জনাব নুরুল আজম রনির কাছে- আপনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিযোগ প্রমানিত সাপেক্ষে যে স্বীকার করলেন ৭ই মার্চে নারী লাঞ্চনার ঘটনা সত্য, সে বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি? এখন কি বলবেন যে স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী মদ্যপ ছিলেন বলে তিনি বুঝতে পারেননি কি বলছেন? নাকী বলবেন তিনিও দেহব্যবসায়ীদের মত ভাড়ায় খাটানো মন্ত্রী? আর ভিডিও ফুটেজ? সেটা তো মিথ্যে নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমি বিশেষ ধন্যবাদ জানাই ঘটনার সত্যতা প্রমানে অগ্রনী ভূমিকা রাখার জন্য।
আমাদের সমস্যা এক না, একাধীক।আমরা ক্ষমতার বলে যা খুশী তাই বলতে পারি। আমরা নিজ মা-বোন লাঞ্চিত হলে প্রতিবাদের ঝড় তুলি, কিন্তু অন্যের মা-বোনের বেলায় তাদের দোষ খুঁজি। আমরা এখন মানুষ আর মানবতা বিচারে কথা বলিনা, আমরা কথা বলি গায়ের জোরে, কথা বলি আমাদের সামাজিক অবস্থানভেদে। উগ্রতা, স্বৈরাচার এখন আমাদের নৈতিকতার বিরুধী। আমরা ভুলে যাই অন্যের মা-বোনের সাথে ঘটে যাওয়া আজকের অপরাধ, কাল আমাদের মা-বোনের সাথেও ঘটতে পারে।
৭১ এর ৭ই মার্চ দেখিনি। তবে আজো যখন সেই ভাষন শুনি, ইতিহাস পড়ি, গা শিউরে উঠে। সেদিনের ৭ই মার্চ আর আজকের ৭ই মার্চ- কত ব্যবধান দেখুন। মাঠ-স্টেডিয়াম ভাড়া করে গান-বাজনায় অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে নৃত্যের মাধ্যমে ৭ই মার্চ উদযাপন করা, নারীদের সমবেত হওয়ার আহ্বান করে তাদের নিরাপত্তা না দিয়ে উল্টো শ্লীলতাহানী করা.. কি বীভৎস অনাচার!
অনেকেই বলতে পারেন, নারীরা সমাবেশে আসে কেন? হ্যা! নারী ছিল এক সময় গৃহবন্দি। এসব সামাজিক সমাবেশে তারা কম বের হত। কিন্তু এখন তারা কেবল ঘরেই বন্দি নয়, তারা বাহির হতে শিখেছে। তবে তাদের এই অগ্রযাত্রা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। অনেকেই নারীকে পাবলিক প্লেসে দেখতে চাননা। যদিও বা তারা নারীকে কোন পাবলিক প্লেসে পেয়ে যান, তবে তাদের বিকৃত মানসিকতা মাথা চারা দিয়ে উঠে। তারা নারীকে হেনস্থা করতে ভয় পাননা। ওইসব বিকৃত রুচির মানুষ নারীকে ‘মানুষ’ হিসাবে দেখেননা। সমস্যা নারীর বাহির হওয়া নয়, সমস্যা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির।
বলতে পারেন, তবে তারা আইনের আশ্রয় না নিয়ে ফেসবুকে অভিযোগ তুলছেন কেন? কি করার আছে বলুন? যে দেশে প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যাকারীরা আইনের ফাঁক দিয়ে খালাশ পেয়ে যায়, সে দেশে নারীর শ্লীলতাহানীর মত ঘটনার বিচার কি হয়? এ তো সামান্য ছুঁয়ে দেখার মত বিনোদন! হতাশাগ্রস্থ্য নির্যাতীতারা মনের ক্ষোভ প্রকাশ করার মাধ্যম হিসাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুককে বেছে নেন। কি করার আছে তাদের?
খারাপ চাহনি, অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশংসা, অশালীন রসিকতা, সবার সামনে গায়ে হাত দেওয়া, কারও চেহারা ও শরীরের গঠন সম্বন্ধে অবাঞ্ছিত মন্তব্য করা… ইত্যাদি কাজগুলো যখন কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে বার বার করা হয়, তখন সেটাকে যৌন হয়রানি বলা হয়। যৌন হয়রানী থেকে রক্ষা পেতে নারীকে গৃহবন্দি করে রাখা অনেকটা জনাবা তারানা হালিমের মত জঙ্গীবাদ দমাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখার মত হাস্যকর। আর যদি কেউ বলেন নারীর ঘরের বাহির হওয়া ও পোশাক যৌন হয়রানীর কারণ, তবে তাদের জানা প্রয়োজন যে, পবিত্র হজে গিয়েও নারীরা হচ্ছেন যৌন হয়রানির শিকার। এ বছর ‘মস্ক-মি-টু’ হ্যাশট্যাগে অনেক নারী জানিয়েছেন, পুরো মাথা শরীর ঢেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েও রেহাই পাননি তারা। ভিড়ের মধ্যে তাদের গায়ে হাত দেয়া হয়েছে বা ধাক্কা দেয়া হয়েছে এবং শরীরে শরীর ঘষা হয়েছে।
প্রমানস্বরুপ লিংকটি দেয়া হল-
(http://www.rtvonline.com/international/33690/হজে-গিয়ে-যৌন-হয়রানি-টুইটারে-নারীদের-প্রতিবাদ)
যৌন হয়রানী একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধী। অধীকাংশ নারীই যৌন হয়রানীর ঘটনা প্রকাশ করেননা। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যেও যারা সাহস করে যৌন হয়রানির ঘটনা ফাঁস করেন, তাদের অভিনন্দন জানাতে হয়।
যৌন হয়রানীর যারা করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না করলে এটা কখনোই বন্ধ হবেনা। সেই সাথে, নুরুল আজিম রনির মত যারা অন্ধ দৃষ্টিতে নারীর যৌন হয়রানীর মত ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে উল্টো ঘটনাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন, তাদেরও দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো বিশেষ জরুরী। নুরুল আজম রনীর কুরুচিপূর্ন স্ট্যাটাসের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
HB Rita
৭ই মার্চের যৌন হয়রানী
৭ মার্চ আওয়ামী লীগের জনসভায় নারী-পুরুষের মিছিলে, বাংলামোটর এলাকায় এক কলেজছাত্রীকে যৌন হয়রানি নিয়ে বিগত কয়েকদিন ধরে ফেইসবুকে তোলপাড় চলছিল। উক্ত কলেজ ছাত্রী তার আনিত অভিযোগ ফেসবুকে পোষ্ট করেন। সেখান থেকেই খবরটি ভাইরাল হয়। শুধু ওই কলেজছাত্রী নয়, আরো কয়েকজন আওয়ামী লীগের জনসভার লাঞ্ছনা ও যৌন হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ করেন।
শান্তিনগর মোড়ে ঘটে যাওয়া যে ফেইসবুক স্ট্যাটাসটি বেশী ভাইরাল হয়, সেই স্ট্যাটাসটিতে ঢাকার এক কলেজছাত্রী লিখেছেন,
“শান্তিনগর মোড়ে একঘণ্টা দাড়ায় থেকেও কোন বাস পাইলাম না। হেটে গেলাম বাংলামটর। বাংলামটর যাইতেই মিছিলের হাতে পড়লাম। প্রায় ১৫-২০জন আমাকে ঘিরে দাড়াইলো। ব্যস! যা হওয়ার থাকে তাই। কলেজ ড্রেস পড়া একটা মেয়েকে হ্যারাস করতেসে এটা কেউ কেউ ভিডিও করার চেষ্টা করতেছে। আমার কলেজ ড্রেসের বোতাম ছিঁড়ে গেছে, ওড়নার জায়গাটা খুলে ঝুলতেছে। ওরা আমাকে থাপড়াইসে। আমার শরীরে হাত দিসে। আমার দুইটা হাত এতগুলা হাত থেকে নিজের শরীরটাকে বাঁচাইতে পারে নাই।”
অপর একজন লিখেছেন,
“হল থেকে বের হয়ে কোন রিক্সা পাইনি। কেউ শাহবাগ যাবে না। হেটে শহীদ মিনার পর্যন্ত আসতে হয়েছে। আর পুরোটা রাস্তা জুড়ে ৭ মার্চ পালন করা দেশভক্ত সোনার ছেলেরা একা মেয়ে পেয়ে ইচ্ছেমতো টিজ করছে। নোংরা কথা থেকে শুরু করে যেভাবে পারছে টিজ করছে।”
ভুক্তভোগী আরেকজনের স্ট্যাটাস ছিল,
“’আজ যে আমি স্বাভাবিক অবস্থায় বাসায় ফিরতে পারবো জানতাম না। এতগুলো হায়েনার চোখ উপেক্ষা করে সাইন্স ল্যাব থেকে কাকরাইল এর জার্নি আমার জন্য কম কষ্টের ছিলো না তাও পুরো পথ হেটে, তবে কিছু কিছু হায়েনার চোখের ভাসা দেখে কেঁদে দিবোই ভাবছিলাম।”
সাতই মার্চের জনসভা ঘিরে যৌন হয়রানির অভিযোগ মিথ্যে ছিলনা। ভিডিও ফুটেজে ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের জনসভায় নারী লাঞ্ছনা ও যৌন হয়রানির সত্যতা মিলেছে বলে রোববার দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁও আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ ব্যাপারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গত বৃহস্পতিবার একটি মামলাও হয়েছে।
ফেইসবুক ঘুরে বিগত কয়েকদিনে ৭ই মার্চে ঘটে যাওয়া নারী লাঞ্চনা নিয়ে বেশ কিছু স্ট্যাটাস চোখে পড়লো। কেউ লিখেছেন, “এগুলো ফেইক আইডি। সবার নজর কাড়তে মেয়েগুলি শো-আপ করছে।” কেউ লিখেছেন, “ফেসবুকে মেয়েগুলি পরিবেশ নষ্ট করে দিল।” কেউ লিখেছেন, “এগুলি বিরুধী দলের উস্কানী। মেয়েগুলি টাকা খেয়েছে।”
কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে ফেসবুকে নিন্দার ঝড় তুলেছে যে স্ট্যাটাসটি তা ছিল ৮ই মার্চে দেয়া অস্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সেক্রেটারী নুরুল আজিম রনির একটি কুরুচীপূর্ণ স্ট্যাটাস।
একজন আওয়ামী ভক্ত ছাত্রলীগ নেতা যিনি নিজ ওয়ালে ‘About’ এ লিখেছেন,”তুমি বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসো, আমি তোমাকে ভালবাসবো”, বলা বাহুল্য তিনি একজন খাঁটি আওয়ামালীগ ভক্ত। তাতে কোন সমস্যা দেখছিনা। আমার প্রিয় নেতাকে বা দলকে আমি ভালবাসতেই পারি। তবে সে ভালবাসায় যদি বিবেক ও চোখ অন্ধ হয়ে যায়, তবে সমালোচনায় পড়তেই হবে। তিনি নিজ স্ট্যাটাসে লিখেছেন,
“বাজারে প্রচুর দেহ ব্যবসায়ী পাওয়া যায় যাদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য আদালতে নারী নির্যাতন মামলা করে থাকেন এই সমাজের এক শ্রেনীর মানুষ।
আদালত সংশ্লিষ্ট আইনজীবিরা এমন অনেক কেইস প্রতিদিন পরিচালনাও করেন।তাদের কাছ থেকে এমন ঘটনাগুলো জেনে নেবেন।
প্রধানমন্ত্রীর পোগ্রামে যারা নারীদের গনহারে যৌনহয়রানী হয়েছে দাবী করে ফেসবুকে কান্না করছেন তাদের পরিবারের মা মেয়ে বউ শালীদের নির্ঘাত ঐ আদালত পাড়ার দেহব্যবসায়ীদের মতো ভাড়ায় খাটানো মামলার বাদী বানানো যাবে।এটা আমার বিশ্বাস।
যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছে দাবী করা ৪ জন নারীর(আসল নাকি নকল আইডি তা জানিনা) স্ট্যাটাস দেখুন।তাদের কথায় বুঝা যাচ্ছে,তারা ৭ই মার্চ দিনটিকে নিয়ে মহা টেনশনে আছেন।যৌন নিপিড়িত কোন নারীর পক্ষে এমন উচ্ছাস প্রকাশ করে অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যদি খালেদা ভক্ত বিএনপির সাবেক নারী সাংসদ শাম্মী আক্তারদের মতো আত্মস্বীকৃত ….নারী হয়ে থাকেন তবে তা অন্য বিষয়।”
তিনি দাবী করেছেন, ৭ই মার্চের সমাবেশে যারা যৌন হয়রানী হয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন, তাদের পরিবারের মা-মেয়ে-বউ-শালীদের আদালত পাড়ায় দেহব্যবসায়ীদের মত ভাড়ায় খাটানো মামলার বাদী বানানো যাবে। তিনি আরো বলেছেন, বাজারে এমন বহু দেহব্যবসায়ী পাওয়া যায় যাদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আদালদে নারী নির্যাতন মামলা করে থাকেন এক শ্রেণির মানুষ।
নুরুল আজিম রনির বক্তব্যে স্পষ্ট যে, তিনি উক্ত অভিযোগকারীদের দেহ ব্যবসায়ী ভাবছেন এবং আনিত অভিযোগগুলো শুধুমাত্র তার প্রিয় দলকে বদনাম করতেই বিরুধী দলের কারসাজি।
আমি জনাব নুরুল আজম রনির কাছে জানতে চাই, আপনার কাছে নারী মানেই কি টাকার বিনিময়ে পাওয়া দেহ? নারীকে এতটা ঘৃণ্য দৃষ্টিতে বিচার করার শিক্ষা কি আপনি পরিবার হতে পেয়েছেন? নাকি এটা কেবল আপনার বিকৃত মানসিকতার বহিপ্রকাশ? আরো একটি প্রশ্ন রাখতে চাই জনাব নুরুল আজম রনির কাছে- আপনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিযোগ প্রমানিত সাপেক্ষে যে স্বীকার করলেন ৭ই মার্চে নারী লাঞ্চনার ঘটনা সত্য, সে বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি? এখন কি বলবেন যে স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী মদ্যপ ছিলেন বলে তিনি বুঝতে পারেননি কি বলছেন? নাকী বলবেন তিনিও দেহব্যবসায়ীদের মত ভাড়ায় খাটানো মন্ত্রী? আর ভিডিও ফুটেজ? সেটা তো মিথ্যে নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমি বিশেষ ধন্যবাদ জানাই ঘটনার সত্যতা প্রমানে অগ্রনী ভূমিকা রাখার জন্য।
আমাদের সমস্যা এক না, একাধীক।আমরা ক্ষমতার বলে যা খুশী তাই বলতে পারি। আমরা নিজ মা-বোন লাঞ্চিত হলে প্রতিবাদের ঝড় তুলি, কিন্তু অন্যের মা-বোনের বেলায় তাদের দোষ খুঁজি। আমরা এখন মানুষ আর মানবতা বিচারে কথা বলিনা, আমরা কথা বলি গায়ের জোরে, কথা বলি আমাদের সামাজিক অবস্থানভেদে। উগ্রতা, স্বৈরাচার এখন আমাদের নৈতিকতার বিরুধী। আমরা ভুলে যাই অন্যের মা-বোনের সাথে ঘটে যাওয়া আজকের অপরাধ, কাল আমাদের মা-বোনের সাথেও ঘটতে পারে।
৭১ এর ৭ই মার্চ দেখিনি। তবে আজো যখন সেই ভাষন শুনি, ইতিহাস পড়ি, গা শিউরে উঠে। সেদিনের ৭ই মার্চ আর আজকের ৭ই মার্চ- কত ব্যবধান দেখুন। মাঠ-স্টেডিয়াম ভাড়া করে গান-বাজনায় অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে নৃত্যের মাধ্যমে ৭ই মার্চ উদযাপন করা, নারীদের সমবেত হওয়ার আহ্বান করে তাদের নিরাপত্তা না দিয়ে উল্টো শ্লীলতাহানী করা.. কি বীভৎস অনাচার!
অনেকেই বলতে পারেন, নারীরা সমাবেশে আসে কেন? হ্যা! নারী ছিল এক সময় গৃহবন্দি। এসব সামাজিক সমাবেশে তারা কম বের হত। কিন্তু এখন তারা কেবল ঘরেই বন্দি নয়, তারা বাহির হতে শিখেছে। তবে তাদের এই অগ্রযাত্রা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। অনেকেই নারীকে পাবলিক প্লেসে দেখতে চাননা। যদিও বা তারা নারীকে কোন পাবলিক প্লেসে পেয়ে যান, তবে তাদের বিকৃত মানসিকতা মাথা চারা দিয়ে উঠে। তারা নারীকে হেনস্থা করতে ভয় পাননা। ওইসব বিকৃত রুচির মানুষ নারীকে ‘মানুষ’ হিসাবে দেখেননা। সমস্যা নারীর বাহির হওয়া নয়, সমস্যা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির।
বলতে পারেন, তবে তারা আইনের আশ্রয় না নিয়ে ফেসবুকে অভিযোগ তুলছেন কেন? কি করার আছে বলুন? যে দেশে প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যাকারীরা আইনের ফাঁক দিয়ে খালাশ পেয়ে যায়, সে দেশে নারীর শ্লীলতাহানীর মত ঘটনার বিচার কি হয়? এ তো সামান্য ছুঁয়ে দেখার মত বিনোদন! হতাশাগ্রস্থ্য নির্যাতীতারা মনের ক্ষোভ প্রকাশ করার মাধ্যম হিসাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুককে বেছে নেন। কি করার আছে তাদের?
খারাপ চাহনি, অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশংসা, অশালীন রসিকতা, সবার সামনে গায়ে হাত দেওয়া, কারও চেহারা ও শরীরের গঠন সম্বন্ধে অবাঞ্ছিত মন্তব্য করা… ইত্যাদি কাজগুলো যখন কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে বার বার করা হয়, তখন সেটাকে যৌন হয়রানি বলা হয়। যৌন হয়রানী থেকে রক্ষা পেতে নারীকে গৃহবন্দি করে রাখা অনেকটা জনাবা তারানা হালিমের মত জঙ্গীবাদ দমাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখার মত হাস্যকর। আর যদি কেউ বলেন নারীর ঘরের বাহির হওয়া ও পোশাক যৌন হয়রানীর কারণ, তবে তাদের জানা প্রয়োজন যে, পবিত্র হজে গিয়েও নারীরা হচ্ছেন যৌন হয়রানির শিকার। এ বছর ‘মস্ক-মি-টু’ হ্যাশট্যাগে অনেক নারী জানিয়েছেন, পুরো মাথা শরীর ঢেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েও রেহাই পাননি তারা। ভিড়ের মধ্যে তাদের গায়ে হাত দেয়া হয়েছে বা ধাক্কা দেয়া হয়েছে এবং শরীরে শরীর ঘষা হয়েছে।
প্রমানস্বরুপ লিংকটি দেয়া হল-
(http://www.rtvonline.com/international/33690/হজে-গিয়ে-যৌন-হয়রানি-টুইটারে-নারীদের-প্রতিবাদ)
যৌন হয়রানী একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধী। অধীকাংশ নারীই যৌন হয়রানীর ঘটনা প্রকাশ করেননা। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্যেও যারা সাহস করে যৌন হয়রানির ঘটনা ফাঁস করেন, তাদের অভিনন্দন জানাতে হয়।
যৌন হয়রানীর যারা করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না করলে এটা কখনোই বন্ধ হবেনা। সেই সাথে, নুরুল আজিম রনির মত যারা অন্ধ দৃষ্টিতে নারীর যৌন হয়রানীর মত ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে উল্টো ঘটনাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন, তাদেরও দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো বিশেষ জরুরী। নুরুল আজম রনীর কুরুচিপূর্ন স্ট্যাটাসের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
HB Rita
Published by HB Rita on Saturday, March 17th, 2018