স্মৃতিতে বাঁধা প্রবাসের ঈদ

প্রবাসের ঈদ ঠিক কতটা আনন্দময়, তার সঠিক ধারণা করা মুশকিল। কেননা প্রবাসের ঈদ কেবল মনে খুশীর জোয়ারই আনেনা, এখানে খুশীর সাথে জড়িত থাকে দুঃখ, বেদনা, হতাশা ও পুরণো স্মৃতি বিজড়িত অনেক অনুভূতি। দীর্ঘদিন প্রাবাস  জীবন কাটিয়ে ঈদ অনেকের জন্য ডায়েট মেনুর বাহিরে গিয়ে শরীরে বাড়তি কিছু ক্যালরী যোগ করা মাত্র! 

তবু ঈদ তো ঈদই। যুক্তির বাহিরে, সারা বছর ঘড়ির কাঁটায় সময় পাড়ি দিয়ে দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর পবিত্র ঈদুল ফিতর সকল মুসলমানের মনে খুশীর উদ্রেক করে। 

এইখানকার ঈদগুলো হয় খুব ভিন্ন। কর্মব্যস্ত দিনের শেষে ঈদের চাঁদ দেখা হয়না অনেকেরই। কোন মসজিদ থেকে চাঁদ দেখা গিয়েছে শুনেই অনেকে ছুটেন ঈদের বাজার সারতে। কেউ কেউ টুকিটাকি ঈদের বাজারগুলো কাজের ফাঁকে আগেই সেরে রাখেন। অনেকেই ঈদের দিন কাটান কর্মস্থলে। সিটি জব কিংবা গভর্মেন্ট জব ছাড়া মিনিমাম বেতনে চাকরী করা কেউই ঈদের ছুটি পায়না। যদিও বা কেউ ছুটি পান, বেতন থেকে তার দৈনিক মজুরী কেটে নেয়া হয়। দেখা যায় অনেকেই ঈদের আগের দিন মাঝ রাত পর্যন্ত রান্না সেরে পরদিন ভোরে ছুটেন কর্মক্ষেত্রে। বিকেলে বাসায় ফিরে যতটা সময় পান, তাতেই ভাগাভাগি করে নেন ঈদের খুশী। এইখানকার বাচ্চারাও ঈদ পালন করে খুব সাদা মাটা। তবে যে পরিবারে পুরুষ কর্তা শুধু কাজ করেন, সে পরিবারের সদস্যদের ঈদ হয় যুগল কর্মব্যস্ত পরিবার থেকে ব্যতিক্রম। 

অথচ আমাদের ছোটবেলায় বাংলাদেশে ঈদের আনন্দ ছিল সীমাহীন।  অধীর আগ্রহে প্রতিটা রমজান গননা করতাম। মায়ের সাথে কিংবা বড় বোনের সাথে রোজ ইফতারের পর মার্কেটে চক্কর দেয়া ছিল বিশাল আনন্দের ব্যপার। নতুন ডিজাইনের জামা কিনতে অপেক্ষা করতাম শেষের দিকের রোজা পর্যন্ত। জামা কিনার পরও লুকুচুরীর ব্যপারটা ছিল এক্সাইটেড। নতুন জামা কিনে লুকিয়ে রাখতাম ঈদের দিন পরবো বলে। কেউ দেখে ফেললেই জামা পুরাণো হয়ে যাওয়ার একটা আতংক কাজ করতো। ঈদের চাঁদ দেখার আনন্দটা ছিল বেশ মজার। ২৯ রমজানে ভাই-বোন একত্রিত হয়ে বাড়ীর উঠোনে জমা হতাম। চাঁদ উঠবে কি উঠবেনা, কখন উঠবে, সে উদ্ধিঘ্নতায় কাটতো প্রতিটা মুহূর্ত। সকল উদ্ধিঘ্নতা কাটিয়ে যখন চাঁদ উঁকি দিত আকাশে, কি যে ভীষণ খুশী লাগতো। তারাবাজি, আতশবাজি জ্বালানোর সাথে ফুল ভলিয়মে বাজাতো ঈদের গান। চাঁদ দেখার পর নানান নঁকশায় হাতে মেহেদী লাগাতাম। ফাঁকে ফাঁকে রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখতাম মায়ের পিঠা ভাঁজা। কত বাহারী রংগের পিঠাই না করা হতো ঈদের আগের দিন রাতে! 

রাতভর ঘুম হতোনা কখন সকাল হবে কখন ঈদ শুরু হবে সে ভাবনায়। চোখে ঘুম চলে  এলেও খুব ভোরে সবার আগে জেগে উঠার তাড়া থাকতো। মনে হত, যত আগে উঠা যায় ঈদ তত বড় হয়! সকাল হতেই গোসল সেরে নতুন জামা-জুতো পড়ে হাতে ছোট মানিব্যাগ নিয়ে সবার পা ছুঁয়ে সালাম করতাম। আত্বীয়দের কেউ এই সালাম থেকে বাদ পরতনা। সালামের তাৎপর্য্য আজ বুঝতে পারলেও সেই সময়টাতে সালাম করা মানে ছিল টাকা কুড়ানো। যত বেশী পা ছুঁয়ে সালাম করতাম, তত বেশী টাকা জমা হতো ব্যাগে। কিছুক্ষন পর পর টাকা গুনে দেখতাম  কত জমা হলো! সালাম শেষে দোয়া চাইতামনা, হাত বাড়িয়ে নতুন চকচকে নোট নিতে উদ্গ্রীব হয়ে থাকতাম। 

আরো একটা বিষয় ঈদের আনন্দকে দ্বিগুন করে দিত, তা ছিল- স্বাধীনতা। সারা বছর বাবার কঠিন শাসনে গন্ডির ভিতর থাকলেও ঈদের দিন ছিল আমাদের ভাই-বোনদের জন্য স্বাধীনতার দিন। বিশেষ করে মেয়ে হবার সুবাদে আমরা বোনরা সব সময় থাকতাম বাবার কড়া নজরে। এই দিন আমরা যা খুশী তাই করতে পারতাম। বাবা বাঁধা দিতনা। যেমন- বান্দবীদের বাড়ী বেড়ানো, রিকসায় করে তাদের সাথে ঘন্টা চুক্তিতে ঘুরে বেড়ানো, আইসক্রীম খাওয়া… ইত্যাদি। 

তারপর এক সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতো। দুঃশ্চিন্তার পাহাড় এসে মাথায় ভর করতো সে সমযটাতে। মনে হতো, ঈদ তো শেষ হযে এলো! এত আনন্দ, এত স্বাধীনতা সব শেষ হযে যাবে! সন্ধ্যা নামার পর পরই ঈদের জামা-জুতো খুলে মানিবযাগ নিয়ে বসতাম হিসাব করতে। সব ভাই-বোনদের থেকে বেশী টাকা জমা হলে আনন্দের সীমা থাকতনা। যদি কম হতো, কান্না জুড়ে দিতাম। এসবই ছিল শৈশব ও কৈশরের ঈদ আনন্দের অংশ।

ছোটবেলা ঈদকার্ড কিনার বিষয়টা ছিল দারুন আবেগী একটা ব্যাপার। ক্লাসের বান্দবীদের জন্য কার্ড লিখতে ব্যবহার করতাম বিভিন্ন রকমের কালি। অভিনন্দন বানীর সাথে সেইসব কালিতে এঁকে দিতাম ফুল-পাখী লতা পাতা। সাথে ভালবাসার কিছু লাইন। ঈদকার্ড কিনতে দুঃশ্চিন্তার অন্ত ছিলনা। সাধারণ ফল্ডিং কার্ড কিনবো নাকি মিউজিকসহ কার্ড কিনবো! যে কার্ড খুলতেই মিউজিক বাঁজতো, সে কার্ডের দাম ছিল বেশী। সেই টাকা জোগাতে ঘ্যানঘ্যান করতাম মায়ের আঁচল ধরে। এখন আর ঈদকার্ড চোখে পড়েনা। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে আমাদের আবেগে আজ ভাঁটা পরেছে। এখন ইকার্ড্র ছড়াছড়ি। বাহারী ডিজাইনে কিছু লিখার দরকার পড়েনা। অনলাইন থেকে ঈদ শুভেচ্ছা কপি পেস্ট করলেই হয়। 

আজ যখন ঈদ আসে, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সেটাও উপভোগ করি। সরকারী চাকুরীর সুবাদে ঈদের দিন ছুটি পাই। যতটা সম্ভব দেশীয় আমেজে পরিবার পরিজন নিয়ে পবিত্র ঈদ উদযাপন করার চেষ্টা করি। কিন্তু কোন এক ফাঁকে শৈশব ও কৈশরের ঈদ মনে ঠিকি উঁকি দিয়ে যায়। বাবাকে ঈদে সালাম করা হয়না এক যুগ! মা’কে সালাম করি খুব প্রত্যুষে। মা এখনো আঁচলের গিঁট খুলে ডলার বের করে দেন। সে ডলার যে আমার থেকেই জমানো! সে ডলার যে ‘চকচকা নতুন টাকার নোট’ নয়! তাতে ঈদ ঈদ গন্ধ আর খু্ঁজে পাইনা! ঈদ আসে, ঈদ চলেও যায়!  তবু কোথায় যেন কিছু একটা ফাঁকা রয়েই যায়! 

তবু ঈদ আমাদের পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান। প্রবাসী জীবনের সকল ব্যস্ততা, দুঃখ হতাশা ও স্মৃতি বিজড়িত সকল বিরহ ব্যন্জনা কাটিয়ে পবিত্র ঈদ বয়ে আনে আমাদের জন্য নতুন কিছু সুখের সমাহার। এই দিনটিতে পুরুণো অনেক আত্বীয় ও বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে গেলে  নানান সাজে জামা-শাড়ী পড়া, টুপি মাথায় নারী-পুরুষের দেখা মিলে। ব্যাচেলর কিংবা কর্মব্যস্ত বাঙ্গালীদের জন্য ঈদ থেমে থাকেনা। বাঙ্গালী রেস্টুরেন্টগুলোতে ঈদের সকল ধরণের খাবারের আয়োজন থাকে। সব মিলিয়ে ঈদ নতুনরুপে প্রবাসেও ধরা দেয়! 

পবিত্র ঈদ বয়ে আনুক সকল প্রবাসীদের জন্য সুখের বার্তা। ঈদ শুভেচ্ছা সবাইকে।