মহান মে দিবসঃ ভাগ্য বিতারিত সাধারণ শ্রমিক

“Labor is the superior of capital, and deserves much the higher consideration- Abraham Lincoln”

মে মাসের ১ তারিখ বিশ্বের বহু দেশে মে দিবস বা শ্রমিক দিবস হিসাবে পালিত হয়। মে দিবস বা শ্রমিক দিবসে দেশের আনাচে কানাচে সর্বত্র যখন মহান মে দিবস কিংবা মে দিবস অমর হোক শ্লোগানটি ধ্বনিত হয়, তখন প্রশ্ন জাগে মনে, আসলে শ্রমিকরা কি আদৌ তাদের পূর্ণ অধীকার ভোগ করতে পেরেছে? ইট, বালু, পাথরে কাদামাটি ঘামে যাদের জীবন কাটে, সেসব শ্রমিকরা অতীতেও সভ্য সমাজের কাছে নিগৃহিত ছিল, আজও তার ব্যতিক্রম নেই। তাদের অনেকেই আজও জানেননা এই দিনটি কেবল তাদের কাজকে সন্মান করতে পালন করা হয়। তবে মহান মে দিবসের ইতিহাসকে সামনে রেখে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা কতটা তারা ভোগ করতে পেরেছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। 

আমার  আজকের লেখাটি মূলত পিছনে ফিরে শ্রমিকদের আত্মহুতিকে স্মরণ করা নয়, বরং আজকের দিনে শ্রমিকদের অবস্থান তুলে ধরা।

মে মাসের ১ তারিখ, দিনটি খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে রক্তঝরা সংগ্রামের দিন। এ দিন ইতিহাসে পাতায় তাদের জন্য একটি গৌরবময় দিন। আজ থেকে ১৩২ বছর আগে ১৮৮৬ সালের এই দিনে শ্রমজীবি মানুষ তাদের বুকের রক্ত ঝরিয়ে অতি নগন্য মজুরীতে সপ্তাহে ৬ দিন গড়ে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা কাজ করার বদলে ৮ ঘন্টা দৈনিক মজুরিতে কাজ করার ‌অধীকার আদায় করে। 

দেশের অর্থনৈতির চাকা সচল রাখতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের সুবিধার্থে সরকার শ্রমবান্ধব আইন করেছে যা “শ্রম আইন ২০০৬” নামে পরিচিত। বাংলাদেশের শ্রম আইনের  ২(৬৫) ধারায় বলা হয়েছে “শ্রমিক” অর্থ শিক্ষাধীনসহ কোন ব্যক্তি, তাহার চাকুরীর শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য যে ভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোন প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোন ঠিকাদার-এর (যে নামেই অভিহিত হউক না কেন) মাধ্যমে মজুরী বা অর্থের বিনিময়ে কোন দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরী, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানীগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন।”____ অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে যারা কল-কারখানায়, মিল-ফ্যাক্টরিতে,গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে,অফিস-আদালতে চাকরি করছে, স্কুল-কলেজে অর্থের বিনিময়ে সকাল সন্ধ্যা শ্রম দিচ্ছেন তাদেরকেই শ্রমিক বলে নির্দেশ করা হয়। যারা মানুষের বাড়িতে ঝি-চাকরের কাজে বহাল আছে, অভাবের কষাঘাতে ঠেলাগাড়ি ঠেলে যে বৃদ্ধ লোকটির নুন আনতে পান্তা ফুরায়, দুধের শিশুকে আঁচলে গিঁট বেঁধে যে মাতা ইট ভেঙ্গে সংসার চালায়, তারা কারা? তারাও তো কোন না কোন মালিক পক্ষের আওতায়ই অর্থের বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করছে! তারাও শ্রমিক। তবে সেই সব শ্রমিকদের পরিশ্রম, ত্যাগ ও অবহেলিত অবস্থার কথা নিয়ে শ্রম আইনে কোন আলোচনা করা হয় না। আলোচনায় আসেনা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোদ বৃষ্টি ঝড়ে দেশের অর্থনৈনিক উন্নয়নে কৃষি ক্ষেত্রে কাজ করা কৃষক শ্রমিকদের কথা। 

শ্রম আইনে স্পষ্ট করে উল্লেখ্য আছে, কোন শ্রমিককে দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি শ্রম করানো যাবে না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে শ্রমিকের ইচ্ছায় ওভারটাইম করানো যাবে। তবে সেক্ষেত্রে শ্রমিককে দুই ঘণ্টার বেশি ওভারটাইম করানো যাবে না। এমনকি শ্রমিকের সম্মতি থাকলে। 

এবং উল্লেখ্য করা আছে যে, ওভারটাইমের জন্য শ্রমিককে দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে।  অর্থাৎ কোন অবস্থাতেই কোন শ্রমিককে দশ ঘণ্টার বেশি শ্রম করানো যাবে না এবং ওভারটাইমের জন্য দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে। 

এ সবই আইনের বইয়ের গল্পকথা। বাস্তবের অবস্থাটা একেবারেই ভিন্ন। এখনো বহু শিল্প কারখানায় বিশেষ করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলোতে একজন শ্রমিককে ১৪ ঘণ্টা থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করানো হয়। কখনো কখনো আরো বেশী। কিন্তু সেইসব শ্রমিকরা কখনো  দ্বিগুণ মজুরি পায়না। শ্রম আইনে এও উল্লেখ্য আছে যে  উপরোক্ত আইন ভঙ্গ করলে মালিককে শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন মালিক এই অবৈধ কাজের জন্য শাস্তি পেয়েছে বলে শোনা যায়নি। 

পুরো বাংলাদেশে প্রায় ছয় কোটি শ্রমিকের জন্য শ্রম আদালত রয়েছে মাত্র সাতটি। যার তিনটিই ঢাকায়, দুটি চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশহীতে রয়েছে একটি করে। সেইসব আদালতেও শ্রমিকরা তাদের দুর্ভোগের জন্য ন্যায্য বিচার ঠিকমত পায়না। তাছাড়া এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে যাতায়াতের অসুবিধার জন্যো তাদের ভুগান্তি পোহাতে হয়। একটি ঘটনা উল্লেখ্য না করলেই না! রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার একটি বিড়ি কারখানায় কাজ করেন জরিনা বানু। টানা ১৫ বছর কাজ করার পর ২০১৫ সালে সাত মাসের বেতনসহ  অন্যান্য পাওনা পরিশোধ না করেই তাকে চাকরিচ্যুত করা দেয় মালিক।  পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারীকে শ্রম আইন অনুসারে পাওনা আদায় করতে রাজশাহীতে গিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করতে হয়। মামলাটি করেন তিনি উক্ত বছরের নভেম্বর মাসে। কিন্তু আজ এতদিনেও তার মামলাটির বিচার শেষ হয়নি। অথচ নিয়মানুসারে ৬০ দিনের মধ্যে তার মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। শ্রম আইনে শ্রমিকদের অধীকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার কতখানি প্রয়োগ হচ্ছে বা হয়, তার মাত্র একটি উদাহরণ- জরিনা বানু। 

(নিউজ- শ্রম আদালত নেই চার বিভাগে-সমকাল/ প্রকাশ: ০১ মে ২০১৮) 

ইটভাটা আইনে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, ছবিসহ পরিচয়পত্র, সার্ভিস বহি প্রদান, রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ, ছুটির রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ, ছুটির বহি প্রদান, সাপ্তাহিক ছুটি, ওভারটাইম রেজিস্ট্রার, দৈনিক রেজিস্ট্রার রাখার কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত ইটভাটার কোনো মালিক শ্রমিকদের জন্য তা কার্যকর করেননি। 

শ্রমিক দিবসে সরকারী ছুটি থাকলেও সে ছুটি ভোগ করেন কেবল সরকারী শ্রমিকগন। কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা সে সুবিধা ভোগ করলেও রোজকার মত শ্রম বিক্রি করতে হয় দৈনিক মজুরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত বহু শ্রমিকদের। কাঁচা ইট টেনে যে শ্রমিকদের হাতে দগদগে ঘা হয়ে যায় তারা জানেনা শ্রমিক দিবস কি! খুব ভোরে উঠে যে শিশুটির বই খাতা ফেলে মায়ের ঔষদ কিনতে টুংটাং চায়ের কাপে দিন শুরু, সে জানেনা তার জন্য কোন আট ঘন্টার শ্রমিক দিবস নেই। পুত্র সন্তানের অবহেলায় যে পিতা বয়সের ভারে নুইয়ে পরতে পরতেও সংসারের খরচ যোগাতে রিকসার প্যাডেল চেপে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, তার জন্য কোন শ্রমিক দিবস নেই। আগুনের উপর দাঁড়িয়ে লোহা গলাতে যে শ্রমিকটির মুখ সারাক্ষণই লাল হয়ে জ্বলছে, তার কাছে শ্রমিক দিবস বলে কিছু নেই। 

তাছাড়া শ্রমিকে শ্রমিকে অবস্থানগত বৈষম্য আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। পোশাক-আসাকে দুরল্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে কাজ করা সরকারি কর্মচারী, কর্পোরেশন বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাবৃন্দ নিজেদেরকে অনেক উঁচু মানের শ্রমিক মনে করেন। তাদের সাথে সাধারণ শ্রমিকদের ব্যবধান আকাশ পাতাল। সাধারণ শ্রমিকদের ভাগ্য নির্ধারণে নীতিমালার ব্যবস্থা সাধারণত মালিক পক্ষ ও উঁচু মানের শ্রমিকরাই করে থাকেন। খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমিকরা যেমন মালিকের সামনে মাথা নিচু করে কথা বলেন, তেমনি উঁচু মানের শ্রমিকদের সাথেও তাদের সম্পর্ক একই রকম। দুই শ্রেণির শ্রমিকদের মাঝে বেতন বৈষম্যও আরো একটি বড় সমস্যা। উৎপাদনের সঙ্গে যারা জড়িত নয় অর্থাৎ যারা দাপ্তরিক কাজ করেন তাদের সঙ্গে সরাসরি উৎপাদনে জড়িত শ্রমিকদের বেতনের বিষয়টিতেও রয়েছে আকাশ পাতাল ব্যবধান। সাধারণ শ্রমিকদের চেয়ে উঁচু মানের শ্রমিকদের বেতন অনেকাংশে বেশী। তাছাড়াউঁচু মানের শ্রমিকদের অনেকেরই গাড়ি-বাড়ি, প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ রয়েছে নানান রকম অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু সাধারন শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এসবের কোন সুবিধাই নেই। বরং অনিরাপদ ও প্রতিকূল পরিবেশে ধূলো-আবর্জনায়ই কাজ করে তাদের অনেকেই রোগ-ব্যাধীতে আক্রান্ত হন।  সরকারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে পেনশনের ব্যবস্থার কথা  বিবেচনা করা হলেও সাধারণ শ্রমিকদের বেলায় তা আকাশ কুসুম ভাবনা।পোশাক ও শিল্পখাতে নারী শ্রমিকের অবদান বেশী হলেও বেতনের বেলায় নারী শ্রমিকরা হচ্ছেন বৈষম্যের শিকার। কৃষি, পরিবহন, মিল কারখানা, দৈনিক মজুরীতে কর্মজীবী মানুষ, শিশু শ্রমিক, নারী শ্রমিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে রয়েছে বেতন বৈষম্য ও সামাজিক অবস্থানগত বৈষম্য। 

মে দিবস এলেই ‘মজদুরের হাতিয়ার’ নিয়ে চিত্রাঙ্কন করে যে সব গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ও ইতিহাস পত্রিকার পাতায় স্থান পায়, রাষ্ট্রীয় আলোচনা সংবর্ধনা পেশ করা হয়, তাতে করে সাধারণ শ্রমিকদের প্রতি লোক দেখানো সন্মান প্রদর্শন করা হলেও, তাতে তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়না; শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় না। 

একজন শ্রমিক ৮ ঘন্টা কাজ করুক কিংবা ১০ ঘন্টাই করুক, সে দাসই’____ কলামটি ছিল অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে এলার্ম নামক একটি পত্রিকার। বর্তমান বাংলােশে বৈষম্যের শিকার সাধারণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কলামটি শতভাগ সত্য।যতদিন পর্যন্ত ‘শ্রমিকের সংজ্ঞা’র সংস্কার না হবে, যতদিন পর্যন্ত শ্রমিকে শ্রমিকে বহুবিধ বৈষম্য দূরীকরণ করা না হবে, ততদিন পর্যন্ত শুধু  বাংলাদেশ নয়, বিশবের মানব সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকারের ভিশন অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের স্বপ্ন পূরণ করতে হলে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণে সরকারকে আরো সুক্ষ্মভাবে শ্রম আইন প্রতিষ্ঠা ও প্রণয়নে নজর দিতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যাপ্ত শক্তিশালী হতে হবে। সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষের আইনি সেবাপ্রাপ্তিকে সহজ করতে হবে। পুঁজিবাদীদের আগ্রাসী দংশন থেকে গোটা শ্রমজীবি সমাজকে বৈষম্য ও শোষনমুক্ত করতে হলে মালিকপক্ষের সাথে, উঁচু মানের শ্রমিকদের সাথে সাধারণ শ্রমিকদের অবস্থানগত সম্পর্ক গুড়িয়ে সমতলে চলে আসতে হবে। তবেই মহান মে দিবসের প্রকৃত স্বীকৃতিলাভ সম্ভব।